Advertisement
১৬ মে ২০২৪
এ বার কোলাঘাট

সিন্ডিকেটের শাসানিতে কাজের বরাতে ছাই

প্রতিকার চেয়ে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম-কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বারবার। এমনকী, রাজ্যের মন্ত্রী থেকে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ, বিধায়ক কারও কাছে দরবার করতে বাকি নেই। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। টেন্ডারে সর্বোচ্চ দর দিয়ে কোলাঘাট তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই (ফ্লাই-অ্যাশ) তোলার বরাত পেয়েও তৃণমূল-আশ্রিত সিন্ডিকেটের ‘দাদাগিরিতে’ এক সংস্থা পাক্কা আট মাস হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ।

প্রসূন আচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
Share: Save:

প্রতিকার চেয়ে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম-কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বারবার। এমনকী, রাজ্যের মন্ত্রী থেকে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ, বিধায়ক কারও কাছে দরবার করতে বাকি নেই।

কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। টেন্ডারে সর্বোচ্চ দর দিয়ে কোলাঘাট তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই (ফ্লাই-অ্যাশ) তোলার বরাত পেয়েও তৃণমূল-আশ্রিত সিন্ডিকেটের ‘দাদাগিরিতে’ এক সংস্থা পাক্কা আট মাস হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ। সংস্থার মালিকদের আশঙ্কা, এই অবস্থা চললে কোলাঘাটের বরাত তো তাঁদের হাতছাড়া হবেই, পিডিসিএলের অন্যান্য কেন্দ্রেও কাজ হারানোর প্রভূত সম্ভাবনা। এতে সংস্থার বেশ কিছু শ্রমিক-কর্মচারীর ভবিষ্যতের আকাশে অনিশ্চয়তার মেঘ ঘনিয়েছে।

আগে তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গত ছাই খোলা পড়ে থেকে পরিবেশকে ভীষণ রকম দূষিত করত। পরে সিমেন্ট শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ফ্লাই-অ্যাশের ব্যবহার শুরু হলে সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়। আর ২০০৯-এ কেন্দ্র নিয়ম করে দিয়েছে, একটি তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০% ছাই ইটভাটায় বিনামূল্যে দিতে হবে, যাতে মাটির বদলে তা দিয়ে ইট বানানো যায়। রাস্তা নির্মাণেও তা কাজে লাগছে। সব মিলিয়ে ফ্লাই-অ্যাশের এখন বিস্তর কদর। বিদেশেও চাহিদা বাড়ছে।

উল্লিখিত সংস্থাটিও বিদেশে ফ্লাই-অ্যাশ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল)-এর অধীনস্থ বক্রেশ্বর ও সাগরদিঘি তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশ ছাই তারাই কেনে। পাশাপাশি সিইএসসি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফরাক্কা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেও প্রচুর ছাই কিনে দেশে-বিদেশে বিক্রি করে লিওনার্দ এক্সপোর্ট নামে সংস্থাটি। কোলাঘাটে এ বছরই তারা প্রথম টেন্ডার জমা দিয়েছিল। সংস্থা-সূত্রের দাবি: অন্যদের দর যেখানে টনপিছু ছাই বাবদ ৫১-৫৪ টাকা, সেখানে তাদের দর ১৩২ টাকা।

সর্বোচ্চ দরের সুবাদে বরাত পেয়েছে লিওনার্দ-ই। অথচ কাজই শুরু করা যাচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ। যার প্রেক্ষাপটে স্থানীয় ছাই-সিন্ডিকেট চক্রের দিকে আঙুল উঠছে। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূলেরই একাংশের ছত্রচ্ছায়ায় সেই সিন্ডিকেট একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছে, গায়ের জোর খাটাতেও কসুর করা হচ্ছে না। “ছাই তুলতে লরি বা ডাম্পার লাগালেই জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি আসছে। নিরাপত্তার অভাবে স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে আছি।” আক্ষেপ করছেন লিওনার্দের অন্যতম অংশীদার প্রবীণকুমার দারোলিয়া। তাঁর দাবি, বিদ্যুৎমন্ত্রী থেকে তৃণমূলের স্থানীয় সাংসদ ও স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ককে পুরো ঘটনা একাধিক বার জানানো হয়েছে। নিগম-কর্তৃপক্ষের কাছেও সুরক্ষার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে। কিছুতেই কিছু হয়নি।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে কোলাঘাটের ফ্লাই-অ্যাশ যারা তুলছে, তাদের একাংশের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে উঠেছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। যা নিয়ে তদন্ত চালিয়ে রাজ্য পুলিশের দুর্নীতিদমন শাখা কোলাঘাট থানায় মামলাও রুজু করেছে। অভিযোগ, সংস্থাগুলি অস্তিত্বহীন ইটভাটার নামে বিনা পয়সায় ছাই নিয়ে বাজারে বেচছে, ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এমতাবস্থায় টেন্ডার পেশ করে বরাত নিয়েও কাজে নামতে পারছে না নবাগত সংস্থা। এবং গত আট মাস ধরে এ হেন অচলাবস্থা চলতে থাকায় সংস্থাটি এখন বড়সড় আর্থিক ক্ষতির সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে। বরাত হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় রীতিমতো প্রমাদ গুনছেন মালিকেরা। দারোলিয়ার কথায়, “যা পরিস্থিতি, তাতে কোলাঘাটে টেন্ডার বাতিল হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আর্নেস্ট মানি খোয়ানো ছাড়াও পিডিসিএলের অন্য যে সব প্লান্টে আমরা কাজ করি, সেখানেও ব্ল্যাক লিস্টেড (কালো তালিকাভুক্ত) হয়ে যাব।” ওঁরা জানাচ্ছেন, স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে তাঁদের শ’ছয়েক শ্রমিক-কর্মচারী। কাজ এ ভাবে বন্ধ হয়ে গেলে অধিকাংশের রুজি-রুটি বিপন্ন হয়ে পড়বে।

লিওনার্দ কর্তৃপক্ষের দাবি, গত ১২ জুলাই বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্তের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা সমস্যার সুরাহা চেয়েছিলেন। মন্ত্রী যাবতীয় নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও কোনও লাভ হয়নি, সিন্ডিকেটের চোখরাঙানি চলতেই থাকে। গত ১৪ অগস্ট সংস্থার কর্তারা ফের মন্ত্রীর শরণাপন্ন হন। “তার পরেও হাল যে-কে-সে-ই।” বলছেন দারোলিয়া। প্রতিবিধানের আশায় তাঁরা তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সংশ্লিষ্ট পাঁশকুড়া (পূর্ব) কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক বিপ্লব রায়চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা করেছেন একাধিক বার। দারোলিয়া জানাচ্ছেন, বিধায়ক তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। তবু সিন্ডিকেটের বাধা এড়িয়ে ছাই তোলার কাজে হাত দেওয়া যায়নি।

কেন যায়নি? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিদের কী বক্তব্য?

কারও কাছে স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। এ ব্যাপারে বহু বার মণীশবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবহিত বলে জানিয়ে বিধায়ক বিপ্লববাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।” সাংসদ শুভেন্দুবাবু অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, লিওনার্দের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। “কিন্তু আমি তো রাজনৈতিক লোক! এটা পিডিসিএলের ব্যাপার। কে কেন কাজ করতে পারছে না, পিডিসিএল-ই বলতে পারবে।” ব্যাখ্যা দিয়েছেন শুভেন্দুবাবু।

নিগম-কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?

নিগমের সিএমডি দুর্গাদাস গোস্বামী আশ্বাস দিচ্ছেন, “ওই কোম্পানি কাজ করতে চাইলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হবে।” কিন্তু কোম্পানি তো বলছে, সুরক্ষা না-পেয়ে তারা বহু বার পিডিসিএল’কে চিঠি দিয়েছে!

সিএমডি’র জবাব, “আমি জানি না। ওঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।” বর্তমান ঠিকাদার সংস্থাগুলির একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-প্রতারণার যে অভিযোগ, সে সম্পর্কে পিডিসিএল-কর্তৃপক্ষের কী অবস্থান?

নিগমের সিএমডি বলেন, “রাজ্য পুলিশের দুর্নীতিদমন শাখাই এ ব্যাপারে যা তদন্ত করার করছে। আমাদের কিছু করার নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE