শতরূপের বহু মত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই! ৩৪ বছরের বাম-জমানা দেখা বাংলার এই স্লোগান মুখস্থ। কিন্তু সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষের হারানোর মতো ‘গ্র্যান্ড ভিটারা’ মডেলের বিলাসী গাড়ি রয়েছে। কেনার জন্য ২২ লাখ টাকা বাবা দিলেও গাড়িটির মালিক শতরূপই। তাঁর নামেই গাড়িটির ‘রেজিস্ট্রেশন’ করা হয়েছিল।
একজন হোলটাইমার কী করে এত দামি গাড়ি ব্যবহার করেন, তা নিয়ে তৃণমূলের পক্ষে ‘নীতিগত প্রশ্ন’ ওঠার পরে টাকার উৎস জানিয়ে দিয়েছেন শতরূপ। সেই সাফাইয়ের পরেও প্রশ্ন থেকে গিয়েছে বামপন্থীদের একাংশের মধ্যে। একজন ‘আদর্শ’ পার্টি নেতা কি এত দামি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন? গরিবগুর্বো পার্টি কমরেডদের চোখে তিনি কি ‘বুর্জোয়া’ হয়ে যান না?
এমন প্রশ্ন নিয়ে সিপিএম ঘোষিত ভাবে কোনও মন্তব্য এখনও করেনি। তবে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথায় নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন সিপিএমের নবীন ও প্রবীণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। সিপিএমের ‘ইউথ আইকন’ হিসাবে গত বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করা তিন কন্যা দীপ্সিতা ধর, ঐশী ঘোষ এবং মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল। মীনাক্ষী ফোন ধরেননি। ‘কমরেড শতরূপদা’-কে সমর্থন করবেন কি করবেন না নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ঐশী এই বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ। তবে এসএফআই-এর সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক দীপ্সিতা মুখ খুলেছেন। এবং তুলেছেন একটি নতুন প্রশ্ন: ‘‘বামপন্থী মানেই কি শুধু ত্যাগ-তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক হতে হবে নাকি?’’ দীপ্সিতার বক্তব্য, ‘‘আসলে একটা ধারণা তৈরি হয়ে রয়েছে যে, বামপন্থী মানেই গরিবিকে রোম্যান্টিসাইজ় করতে হবে এমনটা নয়।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কারও কি উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না?’’
একই প্রশ্ন করা হয়েছিল সিপিএমের প্রবীণ নেতা রবীন দেবকে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন রাজ্যে দীর্ঘ ১৪ বছর বিধায়ক থেকেছেন। তার আগে ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী আদর্শে চলা রবীন একটা সময়ে ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। তবে ১৯৮৭ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দলের জন্য পূর্ণসময় দেওয়ার ব্রত নেন। হোলটাইমার রবীন কি হোলটাইমার শতরূপের ২২ লাখি গাড়ি ব্যবহারকে সমর্থন করেন?
প্রশ্ন শুনে রবীন প্রথমে এর পিছনে তৃণমূলের রাজনৈতিক অভিসন্ধির কথা তুললেন। পরে নিজেই বললেন, ‘‘এখন এ সব নিয়ে সংবাদমাধ্যম কথা বলছে। কিন্তু আমার মতো যাঁরা চাকরি ছেড়ে হোলটাইমার হয়েছেন, যাঁরা পার্টির কাজ করবেন বলে লোভনীয় চাকরি নেননি, তাঁদের কথা তো কেউ বলে না! হোলটাইমার মানে বোঝেন?’’ যে আদর্শের কথা রবীন বলছেন সেখান থেকে কি শতরূপের অবস্থান অনেকটা দূরে? রবীনের জবাব, ‘‘জীবনধারা নিয়ে সমস্যা তো আছেই। কেউ কেউ শ্রেণিচ্যুত হয়। কেউ কেউ হয় না।’’ তবে পরক্ষণেই যুবনেতা শতরূপের পাশে দাঁড়িয়ে রবীন বলেন, ‘‘ও অনেক ক্ষেত্রেই আত্মত্যাগ করছে। এখন ওকে এ দিক-ও দিক যেতে হয়। অনেকে অনেক কিছু দেয়। ওর বাবা কাজের সুবিধার জন্য এটা দিয়েছে। যাতে ও বেশি করে মানুষের জন্য কাজ করতে পারে।’’
হোলটাইমারের জীবনধারা কি মেনে চলেছেন শতরূপ? রবীনের জবাব, ‘‘অন্য ক্ষেত্রে তো জীবনধারা ঠিক আছে। গাড়ি চড়া বা প্লেন চড়া তো সময় বাঁচানোর জন্য। আমরা হেঁটে হেঁটে করেছি। কিন্তু এখন কি আর সেটা সম্ভব?’’ সময় বাঁচানোর জন্য কি গাড়ি ‘দামি’ হওয়া দরকার? এই প্রশ্নের আর জবাব দিতে চাননি রবীন।
তবে দীপ্সিতার জবাব একেবারে স্পষ্ট। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের দলের ক্ষেত্রে তো একটা শৃঙ্খলার বিষয় রয়েছে। যেমন আমরা যদি কোনও উপার্জন করি, সে ক্ষেত্রে তার একটা অংশ লেভি হিসাবে দলকে দিতে হয়। আমি যদি পার্টির হোলটাইমার হই, তা হলেও কিছু নির্দিষ্ট জীবনযাপন, জীবনধারণ, শৃঙ্খলা মানতে হয়। সেটায় কোনও গন্ডগোল হচ্ছে কি না দেখার দায়িত্বও পার্টির। কারও আচরণের ক্ষেত্রে যদি বিচ্যুতি দেখা যায়, তবে দল ব্যবস্থা নেয়।’’ এর পর দীপ্সিতার সংযোজন, ‘‘এই মুহূর্তে যে বিতর্কটা শুরু হয়েছে, মানে তৃণমূল তৈরি করেছে, মিলি চক্রবর্তীর জয়েনিং লেটার থেকে শতরূপ’দার গাড়ি চড়ার— এগুলো আসলে তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতারা যে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে, একটার পর একটা নাম যে ভাবে সামনে আসছে, সেটা থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতে।’’
এর পরেই দীপ্সিতা তুলেছেন বামপন্থীদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণার প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘বামপন্থীদের সম্পর্কে আমরাই একটা ধারণা তৈরি করেছি। অনেক সময়ে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকেরাও একটা ধারণার শিকার হন। যেখানে মনে করা হয়, আপনাকে যদি বামপন্থী পার্টি করতে হয়, কমিউনিস্ট পার্টি করতে হয়, তবে আপনাকে একটা অদ্ভুত সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তো মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচার জীবন দেওয়ার কথা বলে। তাই কারও উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ভাল থাকার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাই আমরা নস্যাৎ করে দেব।’’
এখানেই থামেননি দীপ্সিতা। নিজের সংগঠন এসএফআই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মিছিল বা মিটিংয়ে যাঁরা গ্রাম থেকে, পিছিয়ে-পড়া পরিবার থেকে আসেন, তাঁদের অনেকের কাছেই স্মার্টফোন রয়েছে। অনেকের কাছে ডিজিটাল ওয়াচ রয়েছে। আমি বলছি না, তাঁদের জীবন খুব বিলাসবহুল। তবে প্রত্যেকের একটা উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা থাকে। সকলেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চান। হয় তো অনেক কষ্টে এক টাকা, দু’টাকা করে জমিয়ে ফোন বা ঘড়ি কিনেছেন। সেটার জন্য যদি তাঁর আদর্শের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলি, যদি মনে হয় এটা অকমিউনিস্ট সুলভ আচরণ হয়ে গেল, তবে আমরা প্রগতির উল্টো দিকে হাঁটব।’’
বস্তুত, কমিউনিস্টদের নিয়ে এই ধারণা ভাঙতে চান সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের নেত্রী দীপ্সিতা। কেউ দুর্নীতি করছেন কি না, সেটা নিয়ে সতর্ক থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন। শতরূপ প্রসঙ্গে দাবি করেন, ‘‘কোনও দুর্নীতিতে যখন জড়িত থাকার অভিযোগ নেই, তখন এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ে হিসাবে আমরা খুব ব্যথিত বা চিন্তিত নই। বরং আমাদের ভবিষ্যৎ যাঁরা বেচে দিচ্ছেন, তাঁদের কী করে জেলে পাঠানো যায়, তা নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত।’’ তার পরেই দীপ্সিতার মোক্ষম জবাব, ‘‘বামপন্থী হলেই তোমার কোনও উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না, এমন ধারণা ভাঙতে হবে! বামপন্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অনেকে একটা অদ্ভুত আত্মত্যাগের দিকে ঠেলে দিই। যে, তুমি বামপন্থী হলে তোমার কোনও উত্তরণের ইচ্ছা থাকতে পারে না। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তো আসলে আকাঙ্ক্ষা তৈরি এবং উত্তরণের জন্যই তৈরি হওয়া। কমিউনিস্ট মানেই ত্যাগ-তিতিক্ষা জুড়ে দিই, যদি বলে দিই তাঁর কোনও আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না, সেটা ভুল।’’
প্রসঙ্গত, আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষে যোগাযোগ করা হয়েছিল সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সঙ্গেও। তিনি শুধু বলেন, ‘‘কুণাল ঘোষের প্রশ্ন নিয়ে শতরূপই যথেষ্ট। আসলে তৃণমূল বিষয়টাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতে চাইছে। এই ব্যক্তিলড়াইয়ের মধ্যে আমরা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy