Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কাঁটা সবার ঘরেই, বুঝছে টিম-মমতা

সাবেক উত্তর, সাবেক দক্ষিণ। এক দিকে বাগবাজার, অন্য দিকে গড়িয়াহাট। বরাবরই ভোটে কলকাতার এই দুই প্রান্ত শাসক দলকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু এ বারের পুরভোটে থমকে গেল সেই রথের চাকা। মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পুরমন্ত্রী, বিধানসভার মুখ্য সচেতক— স্বস্তি নেই কারও ‘ঘরেই’।

বুধবার নবদ্বীপের রবীন্দ্রভবনে প্রশাসনিক বৈঠকে যাওয়ার পথে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

বুধবার নবদ্বীপের রবীন্দ্রভবনে প্রশাসনিক বৈঠকে যাওয়ার পথে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৫
Share: Save:

সাবেক উত্তর, সাবেক দক্ষিণ। এক দিকে বাগবাজার, অন্য দিকে গড়িয়াহাট। বরাবরই ভোটে কলকাতার এই দুই প্রান্ত শাসক দলকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু এ বারের পুরভোটে থমকে গেল সেই রথের চাকা। মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পুরমন্ত্রী, বিধানসভার মুখ্য সচেতক— স্বস্তি নেই কারও ‘ঘরেই’।

এ বার আর উত্তরে বাগবাজারে তৃণমূলের জয়ধ্বজা উড়ল না। দক্ষিণের হাল আরও খারাপ। গড়িয়াহাট তো বটেই, সেখান থেকে বড়জোর এক কিলোমিটার দূরের লেক মার্কেট এলাকাতেও ঘাসফুল সরিয়ে পদ্মের জয়জয়কার। এবং ক্রমশ তা সরতে সরতে ধাক্কা মেরেছে যেখানে, সেই ভবানীপুরে এ বার ইন্দ্রপতন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে যেমন-তেমন কোনও তৃণমূল প্রার্থী হারেননি। হেরেছেন বিদায়ী পুরসভার চেয়ারম্যান। এমনকী শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্রে দু’টি ওয়ার্ড তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সিপিএম! বন্দর, টালিগঞ্জ, রাসবিহারীতেও ধাক্কা খেয়েছে ‘টিম-মমতা’র একচ্ছত্র আধিপত্য।

তৃণমূলের অন্দরে আক্ষেপ আর বিস্ময়ের যুগলবন্দি— দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলায় বিরোধীরা কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ‘ঘরের উঠোন’ দক্ষিণ কলকাতা স্বস্তি দিল না মোটেই! ভোটের ফলাফল বলছে, দক্ষিণবঙ্গের মোট ৭৯টি পুরসভার মধ্যে তৃণমূলই দখল করেছে ৬৩টি। অথচ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে সেই তাদেরই বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড হারাতে হল। আর এই সব এলাকায় কিছুটা হলেও ভোট বাড়িয়ে নিল বিরোধীরা।

ভবানীপুরে জন্মলগ্ন থেকে কখনও ফিরে তাকাতে হয়নি তৃণমূলকে। এখানে তাদের এতই প্রভাব যে, তাতে ভর করে আশপাশের এলাকাতেও এত দিন ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘুরিয়েছে শাসক দল। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর মমতা এই ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক হওয়ায় তা বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। তবু সেই নিশ্ছিদ্র বাসরঘরেও ছিদ্র দেখা গেল ২০১৪-র লোকসভা ভোটে। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভবানীপুর বিধানসভা এলাকাতেই তৃণমূলকে পিছনে ফেলে কয়েকশো ভোটে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায়। তাতে ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সীর জয় না আটকালেও এই নিয়ে দলের অন্দরে তোলপাড় হয়েছিল। তার বছরখানেক পরে পুরভোটের ফলাফলেও দেখা যাচ্ছে, ছিদ্র ভরাট তো হয়ইনি, উল্টে শাসক দলকে আরও চিন্তায় ফেলে মুখ্যমন্ত্রীর খাসতালুকে দু’টি ওয়ার্ডে বড় ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল।

ভোটের ফল বলছে, ভবানীপুরের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির কাছে তৃণমূল প্রার্থী সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় হেরে গিয়েছেন প্রায় দু’হাজার ভোটে। ‘‘এই কেন্দ্র হাতছাড়া হতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি’’— মন্তব্য তৃণমূলের এক নেতার। বিদায়ী পুরসভার চেয়ারম্যান সচ্চিদানন্দবাবু কী করে হারলেন, তা নিয়ে নানা মুনি নানা ব্যাখ্যা দিলেও ঘটনা হল, এখানে লোকসভা ভোটের ধারাই অব্যাহত রেখেছে বিজেপি। গত বার ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী ফরওয়ার্ড ব্লক কাউন্সিলর পরে তৃণমূলে যোগ দেন। শাসক দলের আশা ছিল, এ বারের পুরভোটে ওই ওয়ার্ড তাদের ঝুলিতেই আসছে। বাস্তবে তা হয়নি। এ বারেও তৃণমূলের প্রার্থীকে সাড়ে ছ’হাজার ভোটে হারিয়ে সেই ফরওয়ার্ড ব্লকই ওই ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে।

ভবানীপুর থেকে কাঁটা ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণের বিভিন্ন প্রান্তে। যেমন শিক্ষামন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র বেহালা-পশ্চিম। সেখানে দু’টি ওয়ার্ড তৃণমূলের হাত থেকে গিয়েছে সিপিএমের ঝুলিতে। চলে আসুন রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের বিধায়ক বিধানসভার মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এখানেও দু’টি ওয়ার্ড এ বার তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। তৃণমূলের দীর্ঘদিনের ‘গড়’ ৮৬ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছেন বিজেপির তিস্তা বিশ্বাস। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ডেও তৃণমূলের তনিমা চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে আসনটি বের করে নিয়েছে বিজেপি। তনিমাদেবী পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বোন।

শহরের যে বন্দর এলাকা ওঠাবসা করে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কথায়, সেই গার্ডেনরিচ বিধানসভা এলাকায় এ বার হাতের দাপাদাপি। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই এলাকার দু’টি ওয়ার্ড— ১৩৫ এবং ১৪০ এ বার তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। দু’টিই জিতেছে কংগ্রেস। বন্দর এলাকায় কোনও ওয়ার্ড না পেলেও ভাল ভোট পেয়েছে বিজেপি। মমতা-ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ও টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের এলাকাতেও বিরোধীরা ভোট বাড়িয়ে নিয়েছে।

শাসক দলের নেতারা প্রকাশ্যে ‘কিছু হয়নি’ ভাব করলেও ঘনিষ্ঠ মহলে অনেকেই বলছেন, ‘‘যেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকার কথা, সেখানে মশার কামড় কি ভাল লাগে? মশার কামড়েই তো ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া হয়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE