Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
ফিল্মি বাজারেও সিন্ডিকেট ভেঙ্কটেশের

না-মানলেই ফাঁপরে প্রযোজক থেকে এক্সট্রা

অগ্রিম টাকা দিয়ে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওয় ফ্লোর ভাড়া করা হয়েছিল। অথচ নতুন সিরিয়ালের কাজ শুরুর মুখে আচমকা সব ভেস্তে গেল। কারণ, সুরিন্দর ফিল্মসের একটি সিরিয়ালের জন্য ফ্লোরের দরকার!

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:১৪
Share: Save:

অগ্রিম টাকা দিয়ে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওয় ফ্লোর ভাড়া করা হয়েছিল। অথচ নতুন সিরিয়ালের কাজ শুরুর মুখে আচমকা সব ভেস্তে গেল। কারণ, সুরিন্দর ফিল্মসের একটি সিরিয়ালের জন্য ফ্লোরের দরকার!

খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য প্রযোজক গোষ্ঠী শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ‘লবি’ভুক্ত এই সুরিন্দর ফিল্মস। অগত্যা প্রথমে যারা ফ্লোর ভাড়া নিয়েছিল, অ্যাডভান্স ফেরত নিয়ে তাদের মানে মানে সরতে হল অন্য স্টুডিওয়।

মাস দেড়েক আগের সেই বিভ্রাটের শিকার হওয়া প্রযোজক সরাসরি আঙুল তুলছেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ শ্রীকান্ত মোহতার দিকে, যিনি কিনা ভেঙ্কটেশের অন্যতম কর্ণধার। ‘‘সরকারি স্টুডিও তো বটেই, অন্যত্রও শাসকদলের ঘনিষ্ঠ প্রযোজকদের রমরমা। আমাদের সর্বনাশ। স্টুডিওর বাইরে শ্যুটিং করতে গেলে খরচ বিস্তর বেড়ে যাচ্ছে।’’— আক্ষেপ করছেন তিনি। একদা বাংলা চ্যানেলে অজস্র সফল সিরিয়ালের ওই রূপকার এমতাবস্থায় কাজের উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছেন। মাস চারেক আগে স্টার থিয়েটারের ঘটনাটিও চমকপ্রদ। হলের লিজপ্রাপ্ত সংস্থা ঠিক করেছিল, নয়া ডিজিট্যাল প্রযু্ক্তি ‘ইউএমডব্লিউ’-এর মাধ্যমে সিনেমা দেখানো হবে। সাশ্রয়ের তাগিদে কয়েকটি বাংলা ছবির প্রযোজকও রাজি হয়ে যান। কিন্তু নয়া প্রযুক্তি এখনও স্টারের অধরা। সাবেক কিউব প্রযুক্তিতেই প্রদর্শন চলছে। পোহাতে হচ্ছে বাড়তি খরচের ধাক্কা। কারণ, কিউবের ছবি হলের মেশিনে ‘ট্রান্সফার’ করতে কর বাবদ লাগে প্রায় ৮৪ হাজার টাকা, যা কিনা ইউএমডব্লিউ-এর খরচের তিন গুণ। উপরন্তু কিউবে ছবি দেখালে প্রেক্ষাগৃহকে আরও ২০ হাজার টাকা গুণতে হয়, ইউএমডব্লিউ-এ যেটা ন’হাজারের বেশি নয়।

ঘটনাচক্রে, পশ্চিমবঙ্গে কিউবে ছবি প্রদর্শনের এজেন্টের নামও শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস! আর ভেঙ্কটেশের মাধ্যমেই রাজ্যের সিংহভাগ সিনেমাহলে কিউব প্রযুক্তি বলবৎ। সেই সুবাদে বাংলা ছবির যে কোনও প্রযোজক ছবি দেখানোর জন্য হলপিছু অন্তত বিশ হাজার টাকা ভেঙ্কটেশকে দিতে বাধ্য।

অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে বাংলা ছবি থেকে কোটি টাকা মুনাফা লোটার বন্দোবস্ত ভেঙ্কটেশ এ ভাবেই পাকা করে ফেলেছে। যার আশু সুরাহা দেখতে না-পেয়ে অনেকে হতাশ। যেমন প্রযোজক রানা সরকারের মন্তব্য, ‘‘হিন্দি সিনেমায় শো-পিছু চারশো টাকার বেশি লাগে না। বাংলায় এককালীন বিশ হাজার! অথচ ছবি ক’দিন হলে থাকবে গ্যারান্টি নেই!’’

সরকারি প্রেক্ষাগৃহগুলো কী বলে?

কিউব প্রসঙ্গে স্টারের লোকজন মুখ খুলতে চাননি। নন্দনের অধিকর্তা যাদব মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ মেনে আমরা কিউবে ছবি দেখাই। শুনেছি, প্রদর্শনের মানের নিরিখে ওটাই সেরা।’’ যদিও ইন্ডাস্ট্রির একাংশের দাবি, সাধারণ ছোট প্রেক্ষাগৃহে ইউএমডব্লিউ প্রযুক্তি কিউবের তুল্যমূল্য। তুলনায় সস্তা ইউএফও প্রযুক্তির মানও কিউবের সমপর্যায়ের, এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে উন্নততর।

তবু রাজ্য জুড়ে কিউবের মৌরসিপাট্টা অটুট। ইন্ডাস্ট্রিতে ভেঙ্কটেশের প্রভাব অবশ্য এতেই সীমিত নেই। প্রযোজক অশোক ধানুকার পর্যবেক্ষণ, ‘‘টালিগঞ্জে ভেঙ্কটেশ বলতে গেলে সিন্ডিকেট চালাচ্ছে। ইমারতি কারবারে যেমন ইট-বালি-সিমেন্টের সিন্ডিকেট চলে, তেমন ফিল্মি বাজারে হিরো থেকে এক্সট্রা, ডিরেক্টর থেকে হল-মালিক, সবাইকে ওরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।’’ কী ভাবে? এক বর্ষীয়ান পরিচালকের মতে, শক্তির উৎসটা দ্বিমুখী। ‘‘সিনেমা-সিরিয়ালের তারকাদের উপরে ভেঙ্কটেশের প্রভাব শাসকদলের কাছে তাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। আবার শাসকদলের নেকনজরে থাকার দৌলতে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রভাব খাটানোটা দিন দিন সহজ হচ্ছে।’’— ব্যাখা দিয়েছেন তিনি। বস্তুত রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিনোদন জগতকে দলীয় মঞ্চে এনে ফেলাটা অভ্যেসে পরিণত করেছেন তৃণমূলনেত্রী। দেবের মতো তারকাকে ভোটের টিকিট দেওয়া যে কৌশলের অঙ্গ। আর শ্রীকান্ত মোহতাই মমতার সেই কৌশল রূপায়ণের প্রধান হাতিয়ার বলে জানাচ্ছেন ইন্ডাস্ট্রির পাকা মাথারা। এক পরিচালকের কটাক্ষ, ‘‘শ্রীকান্ত এখানেও ডিল করেছেন। আমি তোমাদের স্টার দেব, তোমরা আমায় একচেটিয়া ব্যবসার মওকা দাও!’’ ‘ডিল’ অনেকাংশে সফলও। টালিগঞ্জের অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী জেনে গিয়েছেন, কাজ পেতে গেলে শ্রীকান্তদের তুষ্ট করতে হবে। ‘‘একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ হোক বা সারদায় অভিযুক্তদের সমর্থনে মিছিল, আমাদের থাকতে হবে। নয়তো কাজ জুটবে না।’’— বলেন সিনেমা-সিরিয়ালে চেনা মুখ এক অভিনেত্রী। এক গুচ্ছ সিনেমাহলের মালিক তথা পোড়খাওয়া ডিস্ট্রিবিউটরের স্বীকারোক্তি, ‘‘ভেঙ্কটেশ ও তার লবির প্রযোজকেরা বছরে অন্তত সাত-আটটা সিনেমা করে। ওদের চাহিদাকে কিছুটা আমল তো দিতেই হয়!’’

স্বভাবতই ‘অনুগত’ গোষ্ঠীতে নাম লেখানো না-থাকলে ভুগতে হবে। যেমন হয়েছে সুমন মুখোপাধ্যায়কে। মাসখানেক আগে মুক্তি পাওয়া যাঁর ‘শেষের কবিতা’ ভাল চললেও নন্দন বা প্রিয়ার মতো হল থেকে সেটি সাত-তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয় কিংবা শো টাইম পাল্টে দেওয়া হয়।

প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয়রানির নালিশও কম নয়। যেমন, দু’বছর আগের বড়দিনে একই সময়ে ভেঙ্কটেশের ‘চাঁদের পাহাড়’ ও রানা সরকারের ‘জাতিস্মর’ মুক্তির কথা ছিল। অভিযোগ, ভেঙ্কটেশের চাপে জাতিস্মর-এর মুক্তি পিছিয়ে যায়। আবার গত জুলাইয়ে লন্ডনে অশোক ধানুকার ছবির শ্যুটিং আটকে দেয় তৃণমূল-প্রভাবিত টেকনিশিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন। যুক্তি ছিল, বিদেশের শ্যুটিংয়ে নিয়ম ভেঙে কমসংখ্যক টেকনিশিয়ান দিয়ে কাজ সারছেন ধানুকা। অথচ ব্যাঙ্ককে সুরিন্দর ফিল্মস একই কাণ্ড করে পার পেয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছবির পোস্টার ছেঁড়া, অভিনেতাদের ডেট নিয়ে সমস্যা তৈরি করা, সিরিয়ালের ক্ষেত্রে পছন্দসই স্লট পাইয়ে দেওয়ার জন্যও নানা সময়ে ভেঙ্কটেশের দিকে আঙুল উঠেছে। ভেঙ্কটেশ কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য? সংস্থার দুই কর্তা শ্রীকান্ত মোহতা ও মহেন্দ্র সোনির ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া মেলেনি। তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও মুখ খুলতে চাননি। তবে টালিগঞ্জের অভিভাবকপ্রতিম তারকা প্রসেনজিৎ মনে করছেন, সত্যিকারের ভাল ছবি বা সিরিয়ালের টিকে থাকার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়নি। কী রকম?

প্রসেনজিৎ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘চাঁদের পাহাড়’-এর পরে গত দু’বছরে বক্সঅফিস সফল বাংলা ছবির কোনওটাই কিন্তু ভেঙ্কটেশের নয়। বরং শিবপ্রসাদ-নন্দিতার বেলাশেষে কিংবা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ওপেন টি বায়োস্কোপ-এর পাশে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে ভেঙ্কটেশের তারকাখচিত ছবি। টিভি-সিরিয়ালের জগতেও কেউ কেউ স্রেফ কাজের জোরেই দর্শদের মনে দাগ কেটেছেন।

অতএব, ভেঙ্কটেশ ছাড়া গতি নেই, এমনটা পুরোপুরি মানতে নারাজ প্রসেনজিৎ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE