মুখ ফিরিয়েছে বাজার। উৎপাদিত সামগ্রীতে গুদাম ভরে উঠলেও বাজারের অভাবে তা বিকোবে কোথায়?
‘সহজ সমাধান’ খুঁজতে অধিকাংশ চটকল মালিক তাই লাগাম টানছেন উৎপাদনে। আট ঘণ্টার শিফ্ট কোথাও পাঁচ কোথাও বা তিন ঘণ্টায় নেমে এসেছে। বেশ কিছু চটকলে সরাসরি কোপ পড়েছে শিফ্টে। তিনটের জায়গায় কোথাও বা শিফ্ট কমিয়ে আনা হয়েছে দু’টিতে। ক্রমান্বয়ে উৎপাদনের এই ছাঁটাই প্রক্রিয়ার মাসুল গুনছেন শ্রমিকরা। একটি বেসরকারি সংগঠনের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, বেশ কিছু চটকলে শ্রমিকদের আয় প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
শ্রম দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে চটশিল্পকে চাঙ্গা করতে তাই চটের ‘কোটা’ বা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকে চিঠি দিয়েছেন মলয় ঘটক। সদ্য দায়িত্ব পাওয়া রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী বলছেন, “ছোট ব্যাগ, পাপোস, কাপের্টজুট সামগ্রীতে বৈচিত্র্য এনে বাজার তৈরির একটা চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু চটের বস্তার পুরনো বাজার ফিরিয়ে আনতে না পারলে চটকল শ্রমিকদের সুদিন ফেরা মুস্কিল।” আর সেই ‘সুদিনের’ খোঁজে মলয়বাবুর অস্ত্র সাতাশ বছর আগের একটি আইন।
চটের হারানো বাজারের খোঁজে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছে দুটি পরিচিত সংগঠনও।
রাজ্যের চটকল শ্রমিকদের বকেয়া গ্র্যাচুইটির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে পাঁচ দিনেই সাড়া পেয়েছিল ওই দুই সংগঠন। সেই ভরসাতেই ফের সাউথ ব্লকেরই শরনাপন্ন হয়েছে দুই সংস্থা, ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’ এবং ‘অবসরপ্রাপ্ত জুটমিল শ্রমিক মঞ্চ’। তাদের দাবি, যথেচ্ছ প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক ব্যাগের ব্যবহার কমিয়ে বস্তা বা চটের ব্যাগের ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে হবে। চটকলের ‘সুদিন’ ফেরাতে তাদেরও ভরসা ১৯৮৭ সালের একটি আইন--জুট প্যাকেজিং মেটিরিয়ালস (কমপালসারি ইউজ ইন প্যাকেজিং কমোডিটিস) ১৯৮৭।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় (পিএমও) সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দুই সংগঠনের আবেদন পরিবেশ ও শ্রম দফতরের কাছে ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং শ্রম কর্তাদের মতামত দ্রুত জানাতে নির্দেশও দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়।
সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এই ‘শুভেচ্ছা’র পাশাপাশি রাজ্যের চটশিল্পের বাস্তবিক চেহারাটা কী?
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ৬২টি চটকলের অন্তত ৮টি বন্ধ। ৬টিতে আংশিক উৎপাদন হচ্ছে। মলয়বাবু বলছেন, “বাকি চটকলগুলিতে উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে।” তা কতটা ‘স্বাভাবিক’ তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন চটকল শ্রমিকদের বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং চটকল বিশেষজ্ঞরা।
রাজ্যের চটকল এবং তার শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক জীবনযাপন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন মুম্বইয়ের ‘স্কুল অফ জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল ম্যানেজমেন্ট’-এর দীপঙ্কর বসু। তিনি বলেন, “রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু শিল্প তালিকায় রয়েছে চটকল শিল্প। যার প্রথম কোপটা নামছে চট-শ্রমিকদের উপরেই। ওই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত প্রায় ৮০ লক্ষ শ্রমিকের জীবন রীতিমতো সঙ্কটে।” তাঁর অভিযোগ, শ্রমিকদে-স্বার্থে সরকার বা মালিকপক্ষ কেউই ‘আন্তরিক’ নন। কেন?
তিনি জানান, নিজেদের পুরনো ব্যবসার বাজার ফেরাতে চটকল মালিকরা যদি সত্যিই আগ্রহী হতেন, তাহলে চটের কোটা বাড়ানোর প্রশ্নে তাঁরা এক যোগে কেন্দ্রের উপরে চাপ তৈরি করতেন। তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারেরও নিছক চিঠি লিখেই তাঁদের দায়িত্ব সারছে।
রাজ্যের পরিবেশ দফতরের প্রাক্তন মুখ্য আইন-অফিসার তথা পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরেই চটকল শ্রমিকদের বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা করছেন। চন্দননগরের ‘আইনি সহায়তা কেন্দ্র’-এর হয়ে বিভিন্ন আদালতে ঘুরে ঘুরে আইনি সহায়তে দেওয়া কার্যত তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজিৎবাবুর অভিজ্ঞতা, “চটকল শ্রমিকদের ভাতা ২১৫ থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় শিফ্ট কমে গিয়েছে। ফলে শ্রমিকদের পাওনা কোথাও বা ১৩০ টাকাতেও নেমে এসেছে। অনেকেই রোজ কাজ পাচ্ছেন না।”
১৯৮৭ সালের ওই আইনে চাল-চিনির মতো খাদ্য সামগ্রী চটের বস্তাতেই চালান যাওয়াই বাধ্যতামূলক। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বা হু-এর স্পষ্ট নির্দেশও সে কথাই বলছে। কিন্তু সে নিয়মের তোয়াক্কা করলে তো! বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “নিজের নিয়ম নিজেই ভাঙছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৮৭-র ওই আইনের পরে দেশের অত্যাবশকীয় পণ্যের ৪০ শতাংশই চটের ব্যাগে চালান দেওয়া হত। রাজ্যের চটকলগুলির তখন গড় বাৎসরিক উৎপাদন ছিল প্রায় দেড়-কোটি চটের বস্তা।” কিন্তু দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার সেই কোটা কমিয়ে ২০ শতাংশ করে দেয়। ফলে গত কয়েক বছরে চটের বাজার পড়তে থাকে।
কলকাতার একটি পরিচিক বণিকসভার এক কর্তা বলেন, “গত দশ বছর ধরে প্লাস্টিক লবি বা দেশের প্লাস্টিক শিল্পমহলের রমরমা। তাদের ব্রাত্য করে চটের পুনর্জাগরণ কি এই সরকারও চাইবে?”
সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে চটকলগুলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy