সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম রুখতে ব্যর্থতার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলল কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত রিপোর্টে এসএফআইও বলেছে, সারদা গোষ্ঠী চিট ফান্ড সংক্রান্ত আইন ভেঙেছিল। ওই আইনে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি কাজকারবারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।
রাজ্যের অর্থ দফতরের কর্তারা অবশ্য এসএফআইও-র এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, সারদা বা অন্য অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি চিট ফান্ড নয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারও রাজ্যের হাতে নেই। সেই নিয়ন্ত্রণ চেয়ে সেই বাম আমল থেকেই বারেবারে বিধানসভায় আইন পাশ করে কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়। তৃণমূল আমলেও পাঠানো হয়েছে দু’বার। কিন্তু এখনও কেন্দ্র তাতে সবুজ সঙ্কেত দেয়নি।
কী বলছে এসএফআইও-র রিপোর্ট? কেন্দ্রের কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের হাতে থাকা এই সংস্থা গত সপ্তাহেই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত শেষ করে মন্ত্রকের কাছে গোপন রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারদা গোষ্ঠী কোম্পানি আইন, সেবি আইন ছাড়াও ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করেছিল। পাশাপাশি চিট ফান্ড সংক্রান্ত আইন ‘প্রাইজ চিট্স অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন স্কিম্স (ব্যানিং) অ্যাক্ট (১৯৭৮)’-ও ভেঙেছিল তারা। এসএফআইও-র মতে, এই আইন অনুযায়ী সারদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাজ্য সরকারেরই।
এই রিপোর্ট পাওয়ার পরে আজ কর্পোরেট মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, চিট ফান্ড সংক্রান্ত আইন ভাঙার বহু ঘটনা ঘটেছে। এই আইনে রাজ্য সরকারেরই পদক্ষেপ করার কথা। এসএফআইও-র রিপোর্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের হাতেও তুলে দেওয়া হবে। আর সিবিআই যে হেতু ইতিমধ্যেই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে, তাই যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছে। সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা আজ বলেন, “আমি এখনও এসএফআইও-র রিপোর্ট দেখিনি। রিপোর্ট খতিয়ে দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এসএফআইও-র রিপোর্টের মাধ্যমে এই প্রথম কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সারদা কেলেঙ্কারিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেও সেই অভিযোগ মানতে নারাজ রাজ্যের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে সেবি। এ নিয়ে রাজ্যের কোনও এক্তিয়ারই নেই। তাই বাম আমল থেকেই নতুন আইন তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বিধানসভায় বিল পাশ করে কেন্দ্রের কাছে পাঠানোর পরেও তা পড়ে থাকে দীর্ঘ কয়েক বছর। সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে মমতার সরকার সেই বিল ফেরত নিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অব ইন্টারেস্ট অব ডিপোজিটরস ইন ফিনান্সিয়াল এসট্যাবলিশমেন্ট বিল ২০১৩’ পাশ করায়। বামেদের বিল সংশোধন না-করে নতুন করে বিল তৈরি করায় সে সময় সমালোচনাও হয়েছিল। কিন্তু সেই বিলও কেন্দ্রের অনুমোদন পায়নি। তারা বিলে যে সব আপত্তি তুলেছিল, সেগুলি সংশোধন করে ফের পাঠানোর পরেও তা পড়ে রয়েছে কেন্দ্রের ঘরেই।
আইনজীবীদের একটা বড় অংশ অবশ্য বলছেন, সারদার বেআইনি কাজকর্ম আটকানোর অন্য যে সব পথ ছিল, তা-ও কাজে লাগায়নি মমতার সরকার। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বাম আমলে বেশ কিছু অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্ম বন্ধ করতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সারদার কাজকর্ম গুটিয়ে সুদীপ্ত সেন পিঠটান দেওয়ার আগে পর্যন্ত চোখ বুজেই ছিল তৃণমূল সরকার। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের কথায়, “সরকার সারদার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, এমনকী সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনও কোনও অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
সারদার বিরুদ্ধে কেন্দ্র অবশ্য এখন কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পথেই হাঁটছে। গোপন রিপোর্টে এসএফআইও জানিয়েছে, সুদীপ্ত সেনরা কোম্পানি আইন ভাঙলেও ‘কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’ সংক্রান্ত সেবি-র আইন ভাঙার দায়েই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। কারণ, এই আইনে শাস্তির মেয়াদ অপেক্ষাকৃত বেশি।
এসএফআইও-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় দণ্ডবিধিরও অন্তত নয়টি ধারায় সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। অপরাধে মদত দেওয়া, অপরাধের ষড়যন্ত্র, অসৎ পথে সম্পত্তি আয়ত্ত করা, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা, অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য জাল করার মতো অপরাধ করেছে সারদা গোষ্ঠী। কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, এক দিকে সিবিআই এবং ইডি-র তদন্ত, অন্য দিকে এসএফআইও এবং সেবি-র মামলা এই জাল কেটে সুদীপ্ত সেন ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের বেরনো খুবই কঠিন হবে। সারদা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭০টি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে এসএফআইও। সারদা-র পরে এ বার সেই সংস্থাগুলি সম্পর্কেও রিপোর্ট জমা পড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy