Advertisement
১৭ মে ২০২৪

অভিষেককেও ‘চোর’ বলবে, আগাম বলে দিলেন মমতা

সারদা-কেলেঙ্কারিতে তাঁর নিজের তৈরি পাঁচ জনের তালিকা লোকের মুখে মুখে ঘুরছে এখনও। শুক্রবার আচমকাই সেই তালিকায় নতুন নাম সংযোজন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়! এ দিন কালীঘাটে নিজের বাড়িতে দলের সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা বললেন, এ বার তো বলা হবে, অভিষেক চোর। তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ তখন বৈঠকে উপস্থিত!

দলীয় বৈঠক সেরে নবান্নের পথে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার।—নিজস্ব চিত্র।

দলীয় বৈঠক সেরে নবান্নের পথে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

সারদা-কেলেঙ্কারিতে তাঁর নিজের তৈরি পাঁচ জনের তালিকা লোকের মুখে মুখে ঘুরছে এখনও। শুক্রবার আচমকাই সেই তালিকায় নতুন নাম সংযোজন করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়!

এ দিন কালীঘাটে নিজের বাড়িতে দলের সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা বললেন, এ বার তো বলা হবে, অভিষেক চোর। তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ তখন বৈঠকে উপস্থিত!

সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে ২০১৩ সালের ৩ মে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলের বৈঠকে মমতা নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, “কুণাল চোর? টুম্পাই (সাংসদ সৃঞ্জয় বসু) চোর? মদন চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?” পরে প্রকাশ্য সভাতেও তার পুনরাবৃত্তি করেন। তখনও এঁদের কারও বিরুদ্ধে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু তার পর তদন্ত যত এগিয়েছে, ততই একের পর এক জালে জড়িয়েছেন মমতার তালিকার নেতারা। কুণালকে রাজ্যের পুলিশই গ্রেফতার করেছিল। সিবিআই গ্রেফতার করেছে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্রকে। তলব করা হয়েছে মুকুল রায়কেও। এই অবস্থায় সংগঠনের বেশ কিছু দায়িত্ব মুকুলের হাত থেকে নিয়ে যাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন মমতা, সেই অভিষেকের নাম এ দিন কেন টেনে আনলেন নেত্রী, তা নিয়ে প্রবল জল্পনা শুরু হয়েছে শাসক দলের অন্দরেই।

দলীয় বৈঠকে তৃণমূল নেত্রীর মন্তব্যের কথা জেনে বিরোধীদের প্রশ্ন, সারদা-তদন্তের আঁচ নিজের ঘরে এসে পড়বে বুঝতে পেরেই কি ভাইপোর জন্য আগাম ‘ঢাল’ তৈরি করে রাখার চেষ্টা করলেন মমতা? প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া তালিকা ধরেই তো সিবিআই এগোচ্ছে! আতঙ্কিত হয়ে উনি এর আগে বলেছিলেন, আমরা সবাই চোর। এ বার নিজের ঘরের লোকের নাম নিজেই তালিকায় তুলে দিলেন!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর দাবি, “গোটা তৃণমূল দলটা ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে! ভাইপোর নাম বলে মুখ্যমন্ত্রীই বুঝিয়ে দিলেন, দলের বর্তমান-ভবিষ্যৎ কেউ কেলেঙ্কারির বাইরে নয়!” আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মতে, “মমতা যাবতীয় মন্তব্য করছেন আতঙ্কে দিশাহীন হয়েই।” সেই সঙ্গেই বিরোধীদের দাবি, যুবরাজের নাম নতুন সংযোজন ঠিকই, তবে মমতার তালিকার ‘আমি’ও যেন তদন্ত থেকে বাদ না যায়!

মমতা অবশ্য এ দিন অভিষেকের নাম টেনেছেন চক্রান্তের অভিযোগের সূত্রে। আগেই তিনি দলের নেতা-কর্মীদের বলেছিলেন, দল মদন-মুকুলদের পাশেই আছে। কালীঘাটে দলের বৈঠকে এ দিনও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মদন চোর, মুকুল চোর, বললেই হল? দলের কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে একই সঙ্গে বলেছেন, একটা মুকুলকে ধরে কিছু করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ মুকুল, হাজার হাজার মদন রাস্তায় নামার জন্য তৈরি আছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, বিজেপি-সহ বিরোধী এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ করতে গিয়েই এর পরে মমতা বলেছেন, এর পরে তো যে কোনও দিন অভিষেককে চোর বলা হবে!

দলের একাংশের ব্যাখ্যা, তৃণমূল নেত্রী অভিষেকের নাম টেনেছেন নেহাতই উদাহরণ হিসাবে, চক্রান্তের গভীরতা বোঝাতে। এর থেকে অন্য তাৎপর্য খোঁজা অর্থহীন। কিন্তু দলেরই কেউ কেউ একান্তে প্রশ্ন তুলছেন, “হঠাৎ অভিষেকের নামই বা উনি কেন টানলেন? তা হলে কিছু আঁচ পেয়ে কি আগেভাগে সাফাই গেয়ে রাখছেন?” দলেরই কেউ কেউ আবার বলছেন, মমতার ২০১৩-র সেই মন্তব্য

প্রায় ‘খনার বচন’-এর মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে! এ বার সেই তালিকায় এমন এক জনের নাম তিনি জুড়লেন, যাঁর হাতে তিনি নিজেই দলের ভবিষ্যৎ ছাড়তে চান! স্বাভাবিক ভাবেই যুবরাজের ভাগ্যাকাশে কী মেঘ উদয় হয়, ভেবে বিস্মিত দলের একাংশ!

এ দিন অভিষেকের নাম করার পাশাপাশি দলে ভাঙনের আশঙ্কাও স্বীকার করে নিয়েছেন মমতা। বৃহস্পতিবারই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুরভোট নিয়ে দলীয় বৈঠকে মমতা বলেন, যাঁরা বিজেপিতে যেতে চাইছেন, তাঁরা দল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন! সাম্প্রতিক কালে তৃণমূলের একাধিক জেলা সম্মেলনেও মমতা নেতা-কর্মীদের বলেছেন, কেউ চাইলে তৃণমূল ছেড়ে অন্য দলে যেতেই পারেন। দরজা খোলা আছে! কিন্তু মঞ্জুলের দলত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে এ দিনের মন্তব্যের তাৎপর্য আলাদা বলেই মনে করছে তৃণমূলের বড় অংশ।

এবং এ নিয়ে তৃণমূলের উপরে চাপ বাড়ানোর কৌশল অব্যাহত রেখেছে বিজেপি। রাহুল বৃহস্পতিবারই বলেছিলেন, রাজ্যের আরও এক মন্ত্রী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়। এ দিনও বর্ধমানে তিনি ফের দাবি করেন, “তৃণমূলের অনেকেই বিজেপি-তে যোগ দিতে লাইন দিয়েছেন!” আগামী ২০ জানুয়ারি বর্ধমানে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের সভা করার কথা। সেখানেও রাহুলরা কোনও চমক দেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছে।

তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, তাঁর দলে যে ভাঙন থাবা বসিয়েছে, তা বিলক্ষণ বুঝছেন মমতা। সে জন্য নেতাদের একাংশের দল ছাড়ার খবর আগাম তাঁর কাছে রয়েছে জানিয়ে তার গুরুত্ব হ্রাস করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বৈঠকে মমতা বলেছেন, ‘কিছু পচা লোক’ দলে ঢুকেছে! দলের ভিতরে বসে কেউ কেউ পিছন থেকে ছুরি মারতে চাইছে। যাঁরা এ সব করতে চান, তাঁদের জন্য দরজা খোলা, বেরিয়ে যেতে পারেন! মমতা বুঝিয়েছেন, কারা ‘অন্তর্ঘাত’ করছেন, তিনি জানেন। কিন্তু নিজে থেকে কাউকে চলে যেতে বলছেন না। কেউ চাইলে বেরিয়ে যেতেই পারেন!

কিন্তু এর জেরে সব মিলিয়ে যে দলে অবিশ্বাসের বাতাবরণ হচ্ছে, তা কবুল করছেন তৃণমূল নেতারাই। সেটা স্বয়ং মমতাকে কী ভাবে গ্রাস করেছে তার ইঙ্গিতও মিলেছে এ দিনের বৈঠকে। আলোচনা শুরুর সময় দলের এক জেলা সভাপতি দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়েছিলেন। তাঁকে ধমকে দলনেত্রী বলে ওঠেন, দরজা বন্ধ হোক আর যা-ই করা হোক! দলের কে কোথায় কী ভাবে বাইরে খবর পাচার করে, সবই তাঁর জানা আছে!

রাজ্যের যে সব পুরসভার ভোট আসন্ন, তার মধ্যে তৃণমূলের দখলে থাকা পুরবোর্ডের প্রধান, উপ-প্রধানদের এ দিন বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। মূলত আসন্ন ভোটের রণকৌশল ঠিক করতেই এই আয়োজন। হাজির ছিলেন ওই সব পুরসভা এলাকার সাংসদ ও বিধায়কেরা। ছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম-সহ একাধিক মন্ত্রী ও নেতা। কিন্তু আধ ঘণ্টার বৈঠকে একমাত্র বক্তা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। আর তাঁর বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়েই ছিল বিজেপি-সহ বিরোধী এবং সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ। পুরভোটের প্রচারেও বিরোধী এবং সংবাদমাধ্যমের কুৎসার কথা তুলে আনার নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তিনটি পুরসভার ভোট থাকলেও সেখানকার কোনও পুরপ্রধান বা জেলার সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য এ দিনের বৈঠকে ছিলেন না। দলীয় সূত্রে খবর, ওই সমস্ত পুরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য গত ১১ জানুয়ারি দল থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে দলের তরফেই আবার তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, এ দিনের বৈঠকে আসার দরকার নেই! দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যয় জানিয়েছেন, পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, কাঁথি ও তমলুকের পুর-প্রধানদের নিয়ে পরে আলাদা বৈঠক হবে। ওই জেলার জন্য আলাদা বৈঠক কেন, তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা অবশ্য মেলেনি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE