Advertisement
০২ জুন ২০২৪

আংশিক অনলাইনেও সেই দাদাগিরিরই পথ খোলা

কলেজে কলেজে অনলাইনে ভর্তির ব্যবস্থা ঘোষণার পরেও শেষ পর্যন্ত তা রুখে দিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। জবাবে নতুন শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, যে-সব কলেজ অনলাইনে ভর্তি নিতে পারবে নেবে। কিন্তু এটাও যে আসলে ছাত্র সংসদের দাদাগিরির মুখ আড়াল করার একটা মুখোশই, বাস্তব সেটাই বলছে।

সাবেরী প্রামাণিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

কলেজে কলেজে অনলাইনে ভর্তির ব্যবস্থা ঘোষণার পরেও শেষ পর্যন্ত তা রুখে দিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। জবাবে নতুন শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, যে-সব কলেজ অনলাইনে ভর্তি নিতে পারবে নেবে। কিন্তু এটাও যে আসলে ছাত্র সংসদের দাদাগিরির মুখ আড়াল করার একটা মুখোশই, বাস্তব সেটাই বলছে।

i নদিয়ার একটি কলেজে এ বছর অনলাইনে ভর্তির ফর্ম ডাউনলোড করার সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন কর্তৃপক্ষ। তাতে গোসা হয় তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) পরিচালিত ছাত্র সংসদের। টিএমসিপি-র রাজ্য নেতৃত্বকে বিষয়টি জানায় তারা। নেতৃত্বের নির্দেশে কলেজ-কর্তৃপক্ষের উপরে চাপ দিয়ে ছাত্র ভর্তির গোটা প্রক্রিয়াই ‘অফলাইন’ করতে বাধ্য করানো হয়।

i কলকাতা সংলগ্ন একটি কলেজে ফর্ম ডাউনলোড করে জমা দেওয়া পর্যন্ত অনলাইনে করা সম্ভব বলে অধ্যক্ষকে জানিয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু টিএমসিপি-র দখলে থাকা ছাত্র সংসদ ও তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের ভয়ে সেই পদ্ধতি চালু করতে সাহস হয়নি তাঁর। পুরনো পদ্ধতিতে কলেজে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম তুলে সে-ভাবেই জমা দিয়ে ভর্তি হতে হবে সেখানে।

i অনলাইনে ভর্তির পুরো প্রক্রিয়া চলছে কলকাতার চিত্তরঞ্জন কলেজে। অধ্যক্ষ শ্যামলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, “অনলাইনে ভর্তির ব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আগাম আলোচনা করে নিয়েছি। তাই নিশ্চিন্তে অনলাইনে ছাত্র ভর্তি করা যাবে।”

অর্থাৎ কোথাও দাদাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ। কোথাও তাঁদের চোখরাঙানি। আর কোথাও তাঁদের নির্দেশ নিয়েই নাম-কা-ওয়াস্তে অনলাইন চালু।

২০১৪-’১৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে এমনই বিচিত্র ঘটনা ঘটছে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে। সৌজন্য: বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ভাবে স্নাতকে ভর্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরদারির কোনও সম্ভাবনাই না-থাকায় কলেজের উপরে চাপ দিয়ে ছাত্র সংসদের পছন্দের ছাত্র ভর্তি করানোর পথ এতে সুগম হল বলেই মনে করছে শিক্ষামহলের একাংশ। বাধ্যতামূলক ভাবে অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে রাজ্য সরকার। উচ্চশিক্ষা দফতর জানিয়েছে, বরাবরের মতো এ বারেও ভর্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে কলেজই। দফতরের ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর যে-কলেজ পারবে, তারা অনলাইনে ভর্তি করবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরদারি ছাড়া, বাধ্যতামূলক অনলাইন প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সরকার ভর্তিতে কার্যত ছাত্র সংসদগুলির রমরমাই বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ। ওই সব সংসদের অধিকাংশই শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র দখলে।

টিএমসিপি এবং সরকারের তরফে অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকেই ছাড়া হবে না।

কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমত, ফর্ম ডাউনলোড করে তা জমা দিয়ে সুযোগ পেলে ভর্তির টাকা দেওয়া পর্যন্ত সবই হবে অনলাইনে। ভর্তি অবশ্য হতে হবে কলেজেই। দ্বিতীয়ত, ফর্ম ডাউনলোড করে অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে। মেধা-তালিকাও অনলাইনে দেখা যাবে। ফি জমা দিতে হবে ব্যাঙ্কে বা কলেজে। ভর্তির জন্যও যেতে হবে কলেজে। তৃতীয়ত, কেবল ফর্ম ডাউনলোড করা যাবে অনলাইনে। ফর্ম ও ফি জমা দেওয়া, ভর্তি ইত্যাদি অনলাইনে নয়, কলেজে।

প্রথম ধরনের কলেজ হাতে গোনা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, লেডি ব্রেবোর্ন, মৌলানা আজাদ ছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চিত্তরঞ্জন কলেজে এই ব্যবস্থা চালু আছে। চিত্তরঞ্জন কলেজের অধ্যক্ষ জানান, গত বারেও তাঁরা এই ভাবে ছাত্র ভর্তি করেছিলেন। তাঁর কথায়, “অন্যান্য অধ্যক্ষ ছাত্র সংসদের চাপটা নিতে পারেন না। তাই সর্বত্র এটা করা যায় না। নইলে এই পদ্ধতি চালু করতে সমস্যা নেই।” প্রক্রিয়া চালুর আগে তিনি কলেজের ছাত্র নেতৃত্ব ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে অধ্যক্ষের দাবি।

প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাঙ্কেও ভর্তির টাকা জমা দেওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, প্রেসিডেন্সি, লেডি ব্রেবোর্ন, সেন্ট জেভিয়ার্স, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানে অবশ্য ভর্তিতে ছাত্র সংসদের দাদাগিরির অবকাশ কোনও দিন ছিল না। আজও নেই।

দ্বিতীয় ধরনের কলেজের মধ্যে রয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বঙ্গবাসী কমার্স, মহেশতলা কলেজ ইত্যাদি।

তৃতীয় ধরনের কলেজই বেশি। কলকাতায় প্রায় ৭০টি, বারাসতের রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২৫টি কলেজে ফর্ম ডাউনলোডের সুযোগ আছে। কিন্তু তা জমা দিতে হবে কলেজে গিয়ে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬টি কলেজের মধ্যে শুধু কাঁথি কলেজ ছাড়া সর্বত্র কলেজে গিয়ে ফর্ম জোগাড় করে ভর্তি হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, কাঁথি কলেজে ফর্ম ডাউনলোড করা যাবে অনলাইনে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় অনলাইনে ফর্ম ডাউনলোড করা গেলেও কোথাও তা অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে না।

শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০টি এবং রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খানদশেক কলেজে ভর্তির জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করাই যাবে না। উত্তর ২৪ পরগনার কালীনগর, হিঙ্গলগঞ্জ কলেজ এগুলির অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে ছাত্র সংঘর্ষ, কলেজ-কর্তৃপক্ষের উপরে টিএমসিপি-র চড়াও হওয়ার ঘটনার সূত্রে খবরের শিরোনাম হয়েছে কালীনগর কলেজ। উত্তরবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনও কলেজেই অনলাইন ব্যবস্থা নেই। এমনকী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলিতেও ভর্তি প্রক্রিয়া থেকেই অনলাইন ব্যবস্থা বাদ গিয়েছে বলে সোমবার জানান উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার। অথচ গত বছর স্নাতকে কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ছাত্র ভর্তি করেছিল বর্ধমান।

যে-সব কলেজে গোটা প্রক্রিয়া থেকেই ইন্টারনেট বাদ গিয়েছে, সেখানে না-হয় ছাত্র সংসদের জারিজুরি চলার একটা আশঙ্কা থাকে। কিন্তু যেখানে ফর্ম ডাউনলোড করে জমা দেওয়া পর্যন্ত সবই অনলাইনে হয়, সেখানে ছাত্র সংসদের দাদাগিরির অবকাশ কোথায়?

অধ্যক্ষেরা জবাব দিচ্ছেন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁরা জানান, কখনও ভর্তি হতে আসা পড়ুয়ার মার্কশিট কেড়ে নিয়ে, কখনও বহিরাগতদের দিয়ে কলেজের মূল ফটক জ্যাম করে, কখনও বা ভর্তির লাইনে ইচ্ছে করে গোলমাল পাকিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের ভর্তিতে ব্যাঘাত ঘটায় ছাত্র সংসদ। সেই সুযোগে পছন্দমতো পড়ুয়াদের ভর্তি করে ছাত্র সংসদ। চলে বিরাট অঙ্কের টাকার লেনদেন। অভিযোগ, দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজে এ বছর ভূগোল অনার্সের একটি আসনের দাম এক লক্ষ টাকা, ইংরেজি অনার্সের ৫০ হাজার।

কলেজ-কর্তৃপক্ষ এই দুর্নীতি আটকাতে কিছু করেন না কেন?

কয়েক জন অধ্যক্ষ জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের কাজের কোনও প্রমাণ থাকে না। কিন্তু খুব বিকট ভাবেই থাকে ভয়। সেই ভীতি এমনই যে, অধিকাংশ অধ্যক্ষ বলছেন, “ছাত্র সংসদকে বাধা দিয়ে শেষে কি মার খেয়ে মরব!” কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তি নিয়ন্ত্রিত হলে যে তাঁরা এই ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারতেন, তা-ও স্বীকার করছেন ওই সব অধ্যক্ষের অনেকে। ছাত্র ভর্তিতে কোনও রকম অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্ট পড়ুয়ার রেজিস্ট্রেশন করা হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরদারি থাকলে মেধা-তালিকার বাইরে থেকে, নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ছাত্র ভর্তিতে রাশ টানা যেত। কিন্তু এখন তো তারও উপায় নেই,’ অধিকাংশ অধ্যক্ষের গলায় হতাশা।

ফেব্রুয়ারিতে সরকারি বিজ্ঞপ্তির জেরে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ছাত্র ভর্তির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। সরকারকে তা জানিয়েও দিয়েছিল তারা। গত মঙ্গলবার উচ্চশিক্ষা দফতরের রিভিউ বৈঠকের পরে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানান, কলেজের কাছে নয়। ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কেন্দ্রীয় ভাবে আবেদন জানাতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ই কলেজ-ভিত্তিক মেধা-তালিকা তৈরি করবে। ওই ঘোষণার এক দিন পরে, গত বৃহস্পতিবার নতুন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, কলেজগুলি নিজেদের মতো করেই ছাত্র ভর্তি করবে। তার পর থেকেই ভর্তিকে কেন্দ্র করে গোলমালের আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন কলেজের কর্তারা। তাঁদের আরও আশঙ্কা, যোগ্যতা ও মেধার বদলে ছাত্র সংসদের পছন্দ মেনে নিম্নমেধার পড়ুয়াদের ভর্তি নিতে বাধ্য করানো হবে।

তবে পার্থবাবুর আশ্বাস, সমস্যার কথা তাঁকে জানালেই সুরাহা হবে। সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলে লাভ নেই। তিনি বলেন, “কাউকে ছেড়ে কথা বলা হবে না। ছাত্র সংসদের রোজগারের জন্য তো কিছু করা হয়নি! রাজ্যের ৪৩৬টি কলেজের অধ্যক্ষদেরই বলছি, কোথাও কিছু সমস্যা হলে আমাদের জানান।” এর জন্য শিক্ষা দফতরের একটি টোল-ফ্রি নম্বর চালু করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান মন্ত্রী। ১০ জুনের মধ্যে ভর্তি শুরু হওয়ার কথা। তার মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু হতে পারে।

কিন্তু মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে যে অনেক বাধা! মূর্তিমান সেই বাধা হলেন ছাত্র সংসদ ও শাসক দলের স্থানীয় নেতারা। তাঁদের ভয়ে অধ্যক্ষেরা মুখ খোলার সাহসই কার্যত সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saberi pramanick online registration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE