Advertisement
০৩ মে ২০২৪

‘ইঞ্জিনিয়ার’ ধরে হেরোইন কারখানার খোঁজ সীমান্তে

ইঞ্জিনিয়ার বলে চেনে লোকে। তবে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ নয় ওদের, ঘর-বাড়ি সেতুর নকশাও আঁকে না। পোস্ত গাছের আঠা থেকে হেরোইন তৈরির কারিগর ওরা। নদিয়া, মুর্শিদাবাদের সীমান্ত এলাকায় লোকে ডাকে ‘ইঞ্জিনিয়ার’। বছর খানেক আগে কেন্দ্রীয় সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো এবং রাজ্য পুলিশের হাতে এমনই কয়েকজন ‘ইঞ্জিনিয়ার’ গ্রেফতার হয়েছিল।

দিবাকর রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৮:৫৬
Share: Save:

ইঞ্জিনিয়ার বলে চেনে লোকে। তবে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ নয় ওদের, ঘর-বাড়ি সেতুর নকশাও আঁকে না। পোস্ত গাছের আঠা থেকে হেরোইন তৈরির কারিগর ওরা। নদিয়া, মুর্শিদাবাদের সীমান্ত এলাকায় লোকে ডাকে ‘ইঞ্জিনিয়ার’। বছর খানেক আগে কেন্দ্রীয় সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো এবং রাজ্য পুলিশের হাতে এমনই কয়েকজন ‘ইঞ্জিনিয়ার’ গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের জেরা করে এই রাজ্যে বেশ কয়েকটি হেরোইন তৈরির কারখানার খোঁজ মিলেছে সম্প্রতিউত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ থেকে নদিয়ার কালীগঞ্জ হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা পর্যন্ত যার করিডর ছড়িয়ে। নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। রাজ্যে বেশ কয়েকটি এমন কারখানার খোঁজ মিলেছে। কারিগরদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে একটি চক্র এর পিছনে রয়েছে। তাদের খোঁজ চলেছে।”

গত ২০০৭ সাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মাদক-মাফিয়াদের দাপট বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকি, মধ্যপ্রদেশের মনসোর এবং রাজস্থানের কোটার পাশপাশি হেরোইন মাফিয়াদের ঘাঁটি হিসেবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তালিকায় উঠে এসেছে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদের নাম। নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর কর্তাদের মতে, বরাবাঁকি, মনসোর ও কোটা এলাকার মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে লালগোলা-পলাশি এলাকার পোস্ত চাষিদের। ওই এলাকার গ্রামে-গ্রামে রয়েছে হেরোইন তৈরির কারখানা। এমনকী চলছে হেরোইন রিসার্চ সেন্টার। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে ব্রাউন সুগার।

এনসিবি কর্তাদের মতে, ভৌগোলিক কারণে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া খুব সহজ। পাশাপাশি মায়ানমারে তৈরি হওয়া হেরোইন ওই পথেই দেশে ঢুকছে। শুধু লালগোলা বা পলাশি নয়, মাদক-মাফিয়ারা সক্রিয় বনগাঁ অঞ্চলেও। বছর খানেক আগে ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ী বিমল মণ্ডলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চোখ কপালে উঠেছে এনসিবি কর্তাদের। সেখান থেকে বেশ কয়েক কিলো হেরোইন উদ্ধার করার পাশাপাশি কারখানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এ ছাড়া লালগোলা এলাকা থেকে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাবু নামে এক কারিগরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাদক-মাফিয়াদের কাছে বাবু পরিচিত ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে। বাবুকে গ্রেফতারের সময়ে কয়েক কেজি আফিম, বেশ কয়েক লিটার রাসায়নিক, ওজনের যন্ত্র, বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ও খালি প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। শুধু বাবু নয়, ওই এলাকা থেকে হেরোইন মাফিয়া আনোয়ার খান, আজিজুল শেখ, রবিউল শেখ, গোলাম মুস্তাফি, রেজাউল করিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, মজিবর নামে আরও এক হেরোইন তৈরির কারিগর ওই এলাকায় সক্রিয়। তার খোঁজে তল্লাশি চলেছে।

মাদক-কারবার চলছে কী ভাবে?

পুলিশ জানাচ্ছে, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহ এলাকার চাষিরা মাদক মাফিয়াদের প্রলোভনে পা দিয়ে বেআইনি ভাবে পোস্ত চাষ করছে। এই পোস্ত ফলের গা চিরে বের করা হচ্ছে আঠা। তা থেকে তৈরি হয় মরফিন। সেই মরফিন গ্রাম থেকে সংগ্রহ করছে মাফিয়াদের এজেন্টরা। বেশ কিছুটা মরফিন চলে যাচ্ছে বরাবাঁকি, মনসোর, কোটা এলাকায়। আর বেশ কিছুটা মরফিন থেকে হেরোইন তৈরি হচ্ছে মুর্শিদাবাদের লালগোলা ও নদিয়ার পলাশি লাগোয়া এলাকায়।

কী ভাবে মরফিন থেকে তৈরি হচ্ছে হেরোইন?

এনসিবি-র আধিকারিক জানিয়েছেন, হেরোইন তৈরি করতে বিশেষ কোনও যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। পোস্তর ফল চিরে যে আঠা পাওয়া যায় তা রোদে শুকোনো হয়। তার পরে সেই আঠাকে জলে গুলে বের হয় মরফিন। সেই মরফিনে মেশানো হয় চুন। তার ফলে বিশেষ যৌগ তৈরি হয়। এর পরে সেই যৌগে মেশানো হয় অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও সোডিয়ামের এক রাসায়নিক। তবে হেরোইন তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অ্যাসেটিক অ্যানহাইড্রেড নামে একটি রাসায়নিক যৌগের। বাজারে তা সহজলভ্য নয়। খোলা বাজারে ওই যৌগ বিক্রি করা একেবারে বেআইনি। কিন্তু মাদক মাফিয়াদের দৌলতে তা পৌঁছে যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানেও। দেশের পশ্চিমাংশে অ্যাসেটিক অ্যানহাইড্রেড তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা থেকে চোরাপথে তা সংগ্রহ করছে মাদক মাফিয়ারা। অনেক ক্ষেত্রে আবার অ্যাসেটিক অ্যানহাইড্রেড পাওয়া না গেলে হেরোইনে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। লালগোলা বা পলাশি এলাকায় যে হেরোইন তৈরি হচ্ছে তাতে মেশানো হচ্ছে নানা ধরনের ঘুমের ওষুধ। মেশানো হচ্ছে প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও। একে মাদক কারবার, তাতে আবার ভেজালনজরদারি চালাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই হিমশিম খাচ্ছে নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE