শেষ দফা ছিল ঘাঁটি আগলানোর লড়াই। সোমবার রাজ্যে ১৭টি লোকসভা আসনে দৃশ্যতই দাপিয়ে ভোট করল শাসক দল! তবু দিনের শেষে বুথ-ফেরত সমীক্ষায় গত তিন বছরের নিরিখে তৃণমূলের দাপট কিছুটা কমার ইঙ্গিতই ধরা পড়ল।
বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফল যে অতীতে সব সময়েই মিলে গিয়েছে, এমন নয়। মানুষ আদতে কাকে ভোট দিয়েছেন, সেই রহস্য তাঁরা বুথ-ফেরত সমীক্ষকদের কাছে ফাঁস করতে রাজি হন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবু এই ধরনের সমীক্ষা থেকে নির্বাচনী চালচিত্রের একটা আভাস পাওয়া যায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের করা সমীক্ষা বলছে, তৃণমূল রাজ্যে ২০ থেকে ৩১টি পর্যন্ত আসন পেতে পারে। বামেরা পেতে পারে ৭ থেকে ১৫টি। কংগ্রেসের দখলে আসতে পারে দুই থেকে পাঁচটি। আর বিজেপি-র ভোট এক লাফে অনেকটা বাড়ার ইঙ্গিত মিললেও গড়ে তাদের দু’টির বেশি আসন পাওয়ার ইঙ্গিত নেই।
শেষ পর্বে এ দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজ্যে ৭৯.৭৬% ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর। সন্ত্রাস সত্ত্বেও বহু জায়গায় মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ভোট দিতে গিয়েছেন বলে বিরোধীদের বক্তব্য। সেই ভোট শেষ পর্যন্ত কার বাক্সে যাবে, তা নিয়ে নানা দ্বিধা-অঙ্ক কাজ করছে সব শিবিরেই।
এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, তৃণমূল পেতে পারে ২৪টি আসন। বামফ্রন্ট পেতে পারে ১২টি। কংগ্রেস পাঁচটি এবং বিজেপি একটি আসন। তবে এই সমীক্ষার সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, বামেদের চেয়ে দ্বিগুণ আসন পেলেও তৃণমূল ভোট পেতে পারে তাদের থেকে তিন শতাংশ কম। সমীক্ষার মতে তৃণমূলের পক্ষে ভোট পড়তে পারে ৩৩% (গত বিধানসভায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ভোট ছিল ৪৩%)। আর বামেদের পক্ষে ৩৬%। বিজেপি এ যাবৎ রাজ্যে গড়ে ৪-৫% ভোট পেলেও এ বার মোদী-হাওয়ায় তা বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ১৩%-এ। আর কংগ্রেস গত বারের তুলনায় একটি আসন হারালেও পেতে পারে ১৪% ভোট।
গত লোকসভার নিরিখে দেখলে তৃণমূলের আসনপ্রাপ্তির ইঙ্গিত মোটের উপরে ভালই। গত বার তারা পেয়েছিল ১৯টি আসন। তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের ছিল ৬টি আসন এবং এসইউসি-র একটি। মোট ২৬টি। এ বার তৃণমূল একাই লড়ে যদি তাদের গত বারের আসন সংখ্যা ছাপিয়ে যেতে পারে, তা হলে সেটা নিঃসন্দেহে তাদের লাভ। কিন্তু তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটের নিরিখে ২০০৯-এর প্রাপ্তি ছাপিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল জোট। কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে ৩৪টি লোকসভা আসনে এগিয়েছিল তারা। আলাদা ভাবে তৃণমূল ক’টি আসনে এগিয়েছিল, সেই হিসেব কষা কঠিন হলেও সেটা যে ১৯-এর বেশি তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
সেই হিসেবে এ বারের বুথ-ফেরত সমীক্ষা শাসক দলের প্রতাপ কিছুটা কমে আসারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তৃণমূল শিবিরের যুক্তি, বিধানসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল। যার সুবিধা এ বার তারা পায়নি। তা ছাড়া, তিন বছর আগেকার পরিবর্তনের হাওয়াও এখন সে ভাবে কার্যকর নয়। বরং, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া অল্পবিস্তর তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। উল্টো দিকে, বিজেপির পক্ষে হাওয়া তো আছেই। সে সব বিচার করলে এই ফল নেহাত খারাপ নয়।
প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের আগে এবিপি আনন্দ শেষ যে জনমত সমীক্ষা করেছিল, সেখানে তৃণমূলের ২৮টি আসন পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। তার তুলনায় বুথ-ফেরত সমীক্ষায় কিছু আসন কমেছে।
এ দিনই টাইমস নাও-এর সমীক্ষা দেখাচ্ছে, তৃণমূল ২০টি এবং বামেরা ১৫টি আসন পেতে পারে। কংগ্রেস পেতে পারে পাঁচটি, বিজেপি দু’টি। সিএনএন-আইবিএনের সমীক্ষা বলছে, তৃণমূলের ঝুলিতে আসতে পারে ২৫ থেকে ৩১টি আসন। বামেরা ৭-১১, কংগ্রেস ২-৪ এবং বিজেপি ১ থেকে ৩টি আসন পেতে পারে।
গত বিধানসভার নিরিখে এ বারের বুথ-ফেরত সমীক্ষা যদি তৃণমূলের পক্ষে হতাশার হয়, তা হলে বামেদের জন্য খানিকটা আশার হাওয়া বহন করে আনছে। গত লোকসভায় বামেরা ১৫টি আসন পেলেও বিধানসভা ভোটের নিরিখে দেখা যায়, মাত্র ৭টি লোকসভা আসনে এগিয়ে রয়েছে তারা। পঞ্চায়েত ভোটে আরও করুণ হয়েছিল তাদের হাল। ওই বুথ-ফেরত সমীক্ষা তাদের কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন থাকছে সেখানেও। শেষ দু’দফা ভোটের দিন ময়দান থেকে কার্যত উধাওই হয়ে গিয়েছিল বামেরা। বহু বুথেই তাদের এজেন্টদের দেখা যায়নি। রাস্তা-ঘাটে বাম কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিও ছিল নগণ্য। প্রকাশ্যে বাম নেতৃত্ব শাসক দলের ‘সন্ত্রাস’কেই দুষছেন। কিন্তু মাসতিনেক আগেই শাসক দলের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে যারা ব্রিগেড উপচে লোক আনতে পারে, তারা এজেন্ট দিতে পারবে না কেন? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, “আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি। বহু ক্ষেত্রেই গরিব, সাধারণ ঘরের লোক আমাদের এজেন্ট হন। আজ ভোট হয়ে গেল, কাল তাঁরা আক্রোশের মুখে পড়লেন এটা আমরা চাইনি।”
এই যদি পরিস্থিতি হয়, তা হলে বুথ-ফেরত সমীক্ষা বামেদের ভাল ফলের ইঙ্গিত দিচ্ছে কী করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বুথে কোনও দলের এজেন্ট আছেন কি না দেখে তবে মানুষ তাদের ভোট দেবেন, তেমন পরিস্থিতি আর নেই। পাঁচ বছর আগে লোকসভা ভোটেও বহু জায়গায় তৃণমূলের এজেন্ট ছিল না। তাতে তাদের ভোট পাওয়া আটকায়নি।
তবে বুথ-ফেরত সমীক্ষাকে প্রকৃত ফলাফল বলে মানতে নারাজ বাম শিবির। তাদের প্রশ্ন, তৃণমূলের চেয়ে শতাংশের বিচারে বেশি ভোট পেয়েও বামেদের আসন এত কম হয় কী করে? অনেকের মতে, চতুর্মুখী লড়াইয়ে ভোট কাটাকাটির ফায়দা নিয়ে কিছু আসনে বামেরা জিততে পারে। ভোট ভাগাভাগি হলে কম ভোট পেয়েও কেউ আসন জিতে যেতে পারে। কিন্তু একক ভাবে বামফ্রন্ট বেশি ভোট পেল (এবিপি আনন্দর সমীক্ষা অনুযায়ী), অথচ আসন বেশি জিতল তৃণমূল এর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই! পাশাপাশি সেলিমের প্রশ্ন, “ব্রিগেডের সমাবেশে এসেই অনেক মানুষ নিজেদের নাম-ঠিকানা সংবাদমাধ্যমকে জানাতে চাননি। আর যেখানে ভোট দিতে গেলে মারধর করা হচ্ছে, সেখানে সমীক্ষকদের তাঁরা জানাবেন আমরা বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছি, এটা কত দূর বাস্তবসম্মত?”
তৃণমূল শিবিরও বুথ-ফেরত সমীক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি। শেষ পর্বের ভোটে বুথে লাইন ফুরনোর আগেই সমীক্ষা দেখানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের দাবি, “যাঁরা সমীক্ষা দেখিয়েছেন, তাঁরা এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু আমরা মনে করি, তৃণমূল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভাল ফল করবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy