Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
হাওড়ার প্রাথমিক

কেলেঙ্কারির প্রতিকার চেয়ে ‘বঞ্চিতদের’ ঢল

ঠিক যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছে! দুর্নীতি-অনিয়মের চেহারা বেআব্রু হতেই সুবিধাভোগীদের একাংশ রাতারাতি গা ঢাকা দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিকার চেয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। যাঁদের দাবি, দুর্নীতির শিকার হয়ে ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪২
Share: Save:

ঠিক যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছে! দুর্নীতি-অনিয়মের চেহারা বেআব্রু হতেই সুবিধাভোগীদের একাংশ রাতারাতি গা ঢাকা দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিকার চেয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। যাঁদের দাবি, দুর্নীতির শিকার হয়ে ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা।

হাওড়ায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ‘কেলেঙ্কারির’ খবর আনন্দবাজারে ফাঁস হওয়ার পরে শুক্রবার এমনটাই দেখা গেল। ন্যূনতম যোগ্যতামান না-ডিঙিয়েও চাকরি পেয়ে যাওয়া অনেকের খোঁজ এ দিন হাজার চেষ্টাতেও মেলেনি। উল্টো দিকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উতরে পরীক্ষায় বসে চাকরি না-পাওয়া অনেক ছেলেমেয়ে নিজেরাই এ দিন উজিয়ে এসে আনন্দবাজার দফতরে যোগাযোগ করেছেন। ওঁদের অভিযোগ, স্বার্থান্বেষী চক্রের ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে তাঁরা চাকরির সুযোগ খুইয়েছেন।

আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে, ২০১৪-য় হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ যে ১৮২৬ জনকে শিক্ষক পদে চাকরির নিয়োগপত্র দিয়েছে, তাঁদের অনেকেও যোগ্যতামানের ধারেকাছে নেই! তা সত্ত্বেও ওঁরা হাওড়ার বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে দিব্যি চাকরি করছেন। পর্ষদের কর্তারা জানিয়েছেন, টেট চালু হওয়ার আগে, ২০০৯-এর ৩০ অগস্টের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ২০১০-এ সফল প্রার্থীদের প্যানেল তৈরি হলেও সরকার বদলের পরে তা বাতিল হয়ে যায়, জল গড়ায় হাইকোর্টে। ২০১৪-য় আগের প্রার্থীদের নতুন পরীক্ষা নেয় সংসদ। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে ১৮২৬টি পদে নিয়োগ শুরু হয়ে যায়।

আর তাতেই এই অনিয়মের সন্ধান মিলেছে। নিয়োগকারীদের কাছে যার সদুত্তর মেলেনি। বরং জেলা সংসদের চেয়ারম্যান পুলককান্তি দেব পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ওই প্রার্থীরা তাঁদের নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেয়েছেন। ওঁদের যোগ্যতা দেখার প্রশ্নই ওঠেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বাভাবিক ভাবেই তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে। বিরোধীরা কড়া আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। অন্য দিকে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে সবিস্তারি তদন্ত ও যথোচিত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বস্তুত যোগ্যতার মাপকাঠিতে যাঁরা চাকরি পাওয়ার দাবিতে বিস্তর এগিয়ে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এ দিন বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সামনে এসেছেন। জানিয়েছেন, ওই নিয়োগপর্ব ঘিরে ঠিক কী ঘটেছিল।

যেমন, হাওড়া কদমতলার অর্ণব ঘোষ। মার্কশিট অনুযায়ী, মাধ্যমিকে ওঁর নম্বর ৬৮%, অর্থাৎ ন্যূনতম যোগ্যতামানের উপরে। (২০১০-এর ২২ এপ্রিল সংসদের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, লিখিত পরীক্ষায় বসতে হলে জেনারেল ক্যাটিগরিতে মাধ্যমিকে অন্তত ৬৮% পেতে হবে। এসসি-এসটি’র ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৫৫% ও ৩৪%, ওবিসি’র ক্ষেত্রে ৬৩%।) অর্ণবের দাবি, লিখিত ও মৌখিক (ভাইভা)—সব পরীক্ষাই তিনি ভাল দিয়েছিলেন। সফল তালিকায় নামও উঠেছিল। তবু এত দিনেও নিয়োগপত্র পাননি। অথচ এ দিন কাগজ পড়ে জানতে পেরেছেন, মাধ্যমিকে মাত্র ৩৯% পেয়েও কেউ কেউ চাকরি পেয়ে গিয়েছেন!

এবং তাতেই পুরো ঘটনার মধ্যে গভীর দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন ওঁরা। ‘‘পরীক্ষার বেশ ক’দিন বাদে বাড়িতে দু’জন লোক এসে বলেছিল, পাঁচ লাখ দিলে চাকরি বাঁধা।’’— এ দিন আনন্দবাজার অফিসে বসে দাবি করেন অর্ণব। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মা-বাবা নেই আমার। অত টাকা কোথায় পাব? তাই বোধহয় চাকরিও হল না।’’

ডোমজুড়ের অনুপ মণ্ডলেরও এক অভিযোগ। তফসিলি জাতিভুক্ত ওই প্রার্থীর মাধ্যমিকের নম্বর ছিল প্রায় ৬০%। তাঁর দাবি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা যথেষ্ট ভাল দিয়েছিলেন। অনুপের কথায়, ‘‘পদে পদে অনিয়ম হয়েছে। উত্তীর্ণদের তালিকা টাঙানো হয়নি। পরে সংসদ অফিসে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, আমার নাম প্যানেলে নেই।’’ মাধ্যমিকে ৭০% পাওয়া হাওড়ার রাজা ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এত কম নম্বর পেয়েও যে চাকরি পাওয়া যায়, তা আনন্দবাজার পড়ে জানলাম।’’

এ দিন ওঁদের মতো বহু প্রার্থী পত্রিকা অফিসে চলে এসেছেন। অনেকে টেলিফোনে শুধিয়েছেন, ‘‘এ বার আমরা কার কাছে যাব?’’ অন্য দিকে যোগ্যতামানের বহু নীচে থেকেও চাকরি পাওয়া বেশ কিছু প্রার্থী আচমকা উধাও হয়ে গিয়েছেন। যেমন ডোমজুড় ব্লকের বেগড়ি হাইঅ্যাটাচ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক দেবব্রত ঘোষ। আনন্দবাজারের হাতে আসা তথ্য বলছে, ডোমজুড় বেগড়ির বাসিন্দা দেবব্রতবাবু মাধ্যমিকে পেয়েছেন ৫৭.৮%, অর্থাৎ যোগ্যতামানের চেয়ে ৬% কম। এ দিন তাঁর খোঁজে স্কুলে যাওয়া হলে স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানান, তিনি আসেননি। বাড়িতেও ওঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকী, ওঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিও রাতারাতি মুছে ফেলা হয়েছে!

নিয়োগ কেলেঙ্কারি ঘিরে রাজনীতির জলও ঘোলা হচ্ছে। অবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই-তদন্তের দাবি তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদে নামবে।’’ বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ জানিয়েছেন, এই কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তিনি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে চিঠি লিখছেন। ঘটনার সিবিআই-তদন্ত ও শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছেন রাহুলবাবু।

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE