Advertisement
১৮ মে ২০২৪
আজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৬২তম জন্মতিথি

ঘোলা স্রোতের বিপরীতে চলার দৃঢ়তা

আধুনিকতা হল কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকাখোলা চোখে, মুক্ত মনে, যুক্তির নিরিখে বিচার করা। কোনও একটা মতকে নির্বিচারে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়। কিন্তু কেবল অতীতকে বিসর্জন এবং বর্তমানকে স্বাগত জানানোই আধুনিকতার পরিচয় নয়। আধুনিকতা হল সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, যুগোপযোগী শিক্ষাদীক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া। বস্তুত, আধুনিকতা কোনও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা অবশ্যই কালজয়ী। সে জন্য যে-শিক্ষা বা চিন্তাধারা কালের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বকালীন শিক্ষায় পর্যবসিত হয়, তা-ই যথার্থ আধুনিক।

স্বামী আত্মবোধানন্দ
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৭
Share: Save:

আধুনিকতা হল কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকাখোলা চোখে, মুক্ত মনে, যুক্তির নিরিখে বিচার করা। কোনও একটা মতকে নির্বিচারে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়। কিন্তু কেবল অতীতকে বিসর্জন এবং বর্তমানকে স্বাগত জানানোই আধুনিকতার পরিচয় নয়। আধুনিকতা হল সমকালীন সভ্যতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, যুগোপযোগী শিক্ষাদীক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া। বস্তুত, আধুনিকতা কোনও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা অবশ্যই কালজয়ী। সে জন্য যে-শিক্ষা বা চিন্তাধারা কালের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বকালীন শিক্ষায় পর্যবসিত হয়, তা-ই যথার্থ আধুনিক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীশ্রীমায়ের চিন্তাধারা ও মানসিকতা সর্বার্থে আধুনিক। কারণ, তাঁর জীবন ও বাণী আজও আমাদের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক, যার মধ্যে রয়েছে কালজয়ী চিন্তাভাবনা।

শ্রীশ্রীমা সারদার মধ্যে ছিল না কোনও চোখ-ধাঁধানো সাজে সজ্জিত হওয়ার প্রবণতা, ছিল না কোনও যান্ত্রিক সভ্যতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাও। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক, তাঁর চিন্তা-চেতনায় ছিল অগ্রজ্ঞান, যার দ্বারা তিনি মানবিক চেতনার আলোকে ভাল-মন্দ বিচার করতেন। সে আলোর মধ্যমণি হল চৈতন্য। সেখানে পৌঁছতে হলে লাগে উত্তরণের সোপান। শ্রীশ্রীমা সেই উত্তুঙ্গ স্তর থেকে শুদ্ধ মনে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করতেন, অপরকে অনুসরণ করে নয়। আপন হৃদয়োৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত মৌলিক চিন্তাভাবনার আলোকে তিনি বিচার করতেন।

তৎকালীন সমাজনীতিতে ম্লেচ্ছ বিদেশির সঙ্গে মেলামেশা ছিল চূড়ান্ত অন্যায়। এই নীতি কেউ লঙ্ঘন করলে বিধানদাতারা তাকে সমাজচ্যুত পর্যন্ত করত। এই অনুদার সমাজব্যবস্থার বুকে দাঁড়িয়ে শ্রীশ্রীমা সস্নেহ দুই বাহু প্রসারিত করে কোলে তুলে নিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গিনী মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল তথা ভগিনী নিবেদিতাকে। নিবেদিতা হয়ে ওঠেন মায়ের আদরের ‘খুকি’। তাঁকে স্নেহচুম্বন দিয়েছেন, একাসনে বসিয়ে আহারও করেছেন সামাজিক সকল বাধাকে উপেক্ষা করে। শ্রীশ্রীমায়ের এই আচরণের মধ্যে যে সৎ সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা এ কালের পক্ষেও আধুনিক।

আজ আমরা অনেক প্রচার-প্রসারের কল্যাণে ও বহু ঘাতপ্রতিঘাতের দ্বারা অনেকটাই সচেতন হয়েছি। কিন্তু তৎকালীন সমাজে, সকল প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে শ্রীশ্রীমায়ের যে যুক্তিনিষ্ঠ রুচিশীল মার্জিত মানবিক চেতনার বিকাশ, তা এক নতুন দিকেরই উন্মোচন। সংস্কারাচ্ছন্ন মানবসমাজ তাঁর আচরণের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছে নতুন করে বাঁচার দিশা। নবদিগন্তের দিশারি হয়ে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী চেয়েছিলেন সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে। সমাজবিধানদাতাদের রক্ষণশীল পরিকাঠামোকে তিনি পরিশোধিত করতে চেয়েছিলেন উন্মুক্ত দৃষ্টিস্থাপন সাপেক্ষে। তাই তিনি আপন সংসারেই সাম্যদৃষ্টি নিয়ে বর্ণবৈষম্যের ভেদরেখা উচ্ছেদ করলেন নীতি প্রয়োগ করলেন নিজ ভাইঝির উপর। ভাইঝি রাধু তখন অসুস্থ।

শ্যামাদাস কবিরাজের চিকিৎসাধীন। একদিন কবিরাজ মশায় রাধুকে দেখতে এসেছেন। শ্রীশ্রীমা রাধুকে বলেন কবিরাজ মশায়কে প্রণাম করতে। শ্রীশ্রীমায়ের এই আদেশে সকলেই বিরক্ত। কারণ, তাঁর ভাইঝি রাধু ব্রাহ্মণকন্যা। আর শ্রীশ্রীমা কিনা তাঁকে বললেন একজন বৈদ্যবংশজাত কবিরাজকে প্রণাম করতে! এতেই ছিল সকলের আপত্তি। সমাজের এই বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে দিতে এবং সমাজের উচ্চ-নীচ জাতপাতের ভেদরেখা গুঁড়িয়ে দিতে শ্রীশ্রীমায়ের যুক্তিশীল কণ্ঠ সে দিন সরব হয়ে উঠল: “কবিরাজ মশায় কত বড় বিজ্ঞ! ওঁরা ব্রাহ্মণতুল্য! ওঁকে প্রণাম করবে না তো কাকে করবে?”

শ্রীশ্রীমা নিজেও ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণত্বের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে তিনি আবদ্ধ ছিলেন না। সমস্ত জাতি ও বর্ণের ঊর্ধ্বে তিনি বিচরণ করতেন। কোনও একদেশদর্শী মত তিনি পোষণ করতেন না। তাঁর মুক্ত দৃষ্টিতে যার বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত, শ্রদ্ধাভক্তি অর্জিত হয়েছে, সে-ই ঠিক ঠিক ব্রাহ্মণ-পদবাচ্য।

শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মলাভ করে ব্রাহ্মণত্ব নয়, সাধনোচিত কৃতকর্মেই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করা যায়। শ্রীশ্রীমায়ের এই অভিনব আধুনিক যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ভারতীয় সুপ্রাচীন আদর্শ ও শাস্ত্রবাক্যকে লঙ্ঘন করেনি, বরং শাস্ত্রকে মর্যাদাদানই করেছে। শাস্ত্রবাক্য আচরিত সত্যে বাঙ্ময় রূপ ধারণ করেছে। গীতায় বলা হয়েছে : “চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।” অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে শ্রীভগবান চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। কাজেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে কোনও মনুষ্যজাতিগত প্রভেদ নেই। প্রভেদ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুযায়ী।

কিন্তু এই সনাতন শাস্ত্র-সত্য শাস্ত্রেই নিবদ্ধ। মানবসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেনি এ বিধান। সমাজের নীতি-নির্ধারকেরা এ সত্যকে ভুলে গিয়ে বিধিবদ্ধ প্রচলিত ধারাকেই অনুসরণ করেছে। শাস্ত্রনির্দেশকে তারা গ্রহণ করেনি। কারণ তাদের মধ্যে শাস্ত্রনিষ্ঠতা, সৎসাহসিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব যথেষ্টই। সে জন্য সেখানে নবচেতনার উদ্ভাসন ও নবনীতি প্রণয়নের ক্ষমতাও সীমিত।

আশ্চর্যের বিষয়, সমাজের সমষ্টিশক্তি যেখানে সঙ্কুচিত ও নীরব, সেখানে শ্রীশ্রীমায়ের একক মাতৃশক্তি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ও দুর্নিবার গতিতে সম্প্রসারিত। শাস্ত্রনির্দেশ যেন সরব হয়ে উঠেছে তাঁর দীপ্তকণ্ঠে। তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ বলিষ্ঠ নতুন চিন্তাধারাকে কেউ সে দিন উড়িয়ে দিতে সাহস পায়নি, বরং নীরবে বরণ করেই নিয়েছিল। একক মাতৃশক্তির কাছে যেন সংঘবদ্ধ শক্তি পরাজিত। স্রোতের বিপরীতে চলার এই মানসিক দৃঢ়তা ও চিরাচরিত প্রাচীন ঐতিহ্যকে যুক্তির আলোকে খোলামনে বিচার-বিশ্লেষণ করার এই নবচেতনাকেই বলা হবে আধুনিকমনস্কতা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী আধুনিক প্রতিমা হিসাবে সার্থক রূপ ধারণ করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sarada Devi swami atmabodhananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE