অধীর চৌধুরীকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে শেষ পর্যন্ত ‘বাম-অস্ত্রে’ই বুক বাঁধল রাজ্যের শাসকদল।
কংগ্রেসের গড় মুর্শিদাবাদকে মুঠোয় আনতে, জেলা নেতাদের দাবি উপেক্ষা করেই লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুরে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছিল দলনেত্রীর পছন্দের ইন্দ্রনীল সেনকে। সে অস্ত্রে কাজ হয়নি। দেশ জুড়ে কংগ্রেসের ভরাডুবির বাজারেও নিজের খাসতালুক আঁটোসাঁটো রেখে অধীর জেতেন প্রায় পাঁচ লক্ষ ভোটে।
তাই দশ বছর আগে, বাম জমানায় ব্যবহার করা অধীর-নিয়ন্ত্রণের পুরনো অস্ত্র ‘জ্ঞানবন্ত সিংহেই’ ফের ভরসা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
তার আগে অবশ্য রিজওয়ানুর-কাণ্ডে অভিযুক্ত, রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের প্রথম ব্যাটেলিয়নের কমান্ড্যান্ট জ্ঞানবন্তকে ‘দোষমুক্ত’ করে নিয়েছে রাজ্য সরকার। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তে রীতিমতো দাঁড়ি টেনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছেডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং (ডিপি) থেকে তাঁকে ‘মুক্তি’ (ক্লোজার) দেওয়া হল। বিভাগীয় তদন্তের আওতায় থাকায় ২০০৭ সাল থেকে ওই আইপিএস অফিসারের পদোন্নতি থমকে ছিল। দিন কয়েক আগে, ডিপি থেকে ছাড় মেলায় তাঁর ডিআইজি পদে পদোন্নতি হয়। সিদ্ধান্ত হয়, পদোন্নতির পরে তাঁর প্রথম কর্মস্থল হবে মুর্শিদাবাদ। মনে করা হচ্ছে, তাঁকে পুরনো কর্মক্ষেত্রে পাঠানোর অর্থ একটাইজ্ঞানবন্ত-অস্ত্রে অধীরকে নিয়ন্ত্রণ করে মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে প্যাঁচে ফেলা।
দিল্লি থেকে ফোনে অধীর বলছেন, “আমার বিরুদ্ধে প্যাঁচ কষতে কষতে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মনটাই প্যাঁচালো হয়ে গিয়েছে। ও নিয়ে আর ভাবি না।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির অভিজ্ঞতা বলছে, “বাম আমলে আমাকে কী ভাবে বেকায়দায় ফেলা যায় তা নিয়ে কম সময় ব্যয় করেননি বুদ্ধবাবুরা। এ বার তৃণমূলনেত্রীও সে পথেই হাঁটছেন। বহরমপুরে খুন হলেই আমার নাম জনিয়ে দেওয়াটা এখন ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। সেই মিথ্যা মামলার কাজে যাঁরা দড় তাঁদেরই ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।” বাম-সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন জ্ঞানবন্ত। রিজ-কাণ্ডে জড়ানোর পরেও তাঁকে ডিসি (সদর) পদ থেকে অপসারণের প্রশ্নে গড়িমসির বিরুদ্ধে তখন রাজ্য জুড়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী মমতা। সে ঘটনা অতীত। শাসকদলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “দেড় বছর দূরে বিধানসভা ভোট। ঘরে-বাইরে অধীরকে চাপে রাখতে জ্ঞানবন্ত-দাওয়াই এখন নেত্রীর লক্ষ্য।”
কী ছিল জ্ঞানবন্তের দাওয়াই?
জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়েছিল জ্ঞানবন্ত সিংহকে। কংগ্রেসের অভিযোগ, জেলা পুলিশের দায়িত্ব নিয়েই তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল--দলে ফাটল ধরানো। দলের স্থানীয় বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “প্রথম থেকেই জেলায় অধীর-বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে মদত দিতে শুরু করেন জ্ঞানবন্ত। যার ফল কংগ্রেস ভেঙে ‘ইন্দিরা-রাজীব মঞ্চ’।” অভিযোগ, অধীর-ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের পেটাতে ওই বছরই বহরমপুর শহরে ‘আর্বিভাব’ ঘটে ‘লাঠি-ভূতের’। সন্ধ্যা নামলেই আক্রান্ত হতেন অধীর-ঘনিষ্ঠ নেতারা। সেই সময়ে অধীরের ডান-হাত, পরে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এক নেতার কথায়, “বিক্ষুব্ধ সেই কংগ্রেস নেতারাই জ্ঞানবন্তের মদতে ওই কাজ করতেন। পরে তাঁরাই
আমার কাছে এ কথা কবুল করেছিলেন।” বহরমপুরে জোড়া
খুন এবং স্থানীয় একটি সমবায়ে সংঘর্ষের ঘটনাতেও অধীরকে জড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে। তবে, দুু’টি মামলাতেই আদালত অধীরকে বেকসুর খালাস দেয়। স্থানীয় নেতা অতীশ সিংহ বলেন, “একের পর এক মামলাতেও যখন অধীরদাকে জড়ানো গেল না, তখন এই জ্ঞানবন্তের মদতেই পুলিশ তাঁকে খুনের চেষ্টা করে। কংগ্রেস কার্যালয়ে তাঁকে লক্ষ করেই গুলি চালায় পুলিশ। এক চুলের জন্য বেঁচে যান অধীরদা।”
কী বলছেন জ্ঞানবন্ত? এ দিন বহু চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
সেই জ্ঞানবন্ত সিংহই পদোন্নতির পরে ফিরে গিয়েছেন তাঁর পুরনো কর্মস্থল মুর্শিদাবাদে। যা দেখে জেলা কংগ্রেস নেতাদের টিপ্পনী--এখন দেখার, জ্ঞানবন্তের ঝুলিতে আর কী ‘অস্ত্র’ রয়েছে!
(তথ্য সহায়তা: শুভাশিস সৈয়দ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy