জহর রায়ের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তেলেভাজাকে এত বড় শংসাপত্র আর কেউ দেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেলেভাজাকে শিল্পের তকমা দেওয়ার পরে গদ্গদ ভাবেই বলছেন উত্তর কলকাতার তেলেভাজা হেভিওয়েট লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের সুপুত্র কেষ্ট গুপ্ত (সাউ)।
সে সময় দোকানের উল্টো ফুটেই রংমহল থিয়েটারের রমরমা। নিত্য তেলেভাজার ডায়েটে অভ্যস্ত সুরসিক জহর রায় মুখে-মুখে ছড়া বেঁধেছিলেন, ‘চপ খাব আস্ত, তৈরি করব স্বাস্থ্য/ বেগুনি খাব গোটা, আমরা হব মোটা/ পেঁয়াজি খাব শেষে, খাব ভালবেসে...’। সে-কবিতা এখনও টাঙানো দোকানে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় তেলেভাজার গৌরবগাথা শোনার পর টিভিতে, কাগজে আলোচনা হয়েছে। রসিক খাইয়েদের কারও কারও টিপ্পনী, তেলেভাজা-শিল্পের প্রসারে এ বার এই কবিতাকেও স্কুলের সিলেবাসে ঠাঁই দেওয়া হোক।
লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ বা কলেজ স্ট্রিটের কালিকা-র মতো ‘সফল’ দোকান কিন্তু ব্যতিক্রমই। মমতা যতই তেলেভাজার দৌলতে প্রাসাদ-নির্মাণের আখ্যান শোনান, এ শহরে তেলেভাজার ‘নিহত’ ও ‘আহত’ দোকানই দলে ভারী! কেষ্টবাবু নিজেই বলছেন, “এই তো আমাদের দোকানের পিছনের গলির দোকানটা উঠেই গেল।”
চাঁদনি চক স্টেশনের কাছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের গায়ে খুপরি দোকানে বউ, ছেলেকে নিয়ে আলুর চপ, পেঁয়াজি, বেগুনি, ফুলুরি ভাজেন বিনোদ সাউ। হেসে বললেন, “দোকানের পিছনের অফিস-বাড়িটার সিঁড়িতেই রাতে ঘুমোই আমরা। ওটাই আমাদের ফ্ল্যাট!” চেনা খদ্দেরদের ঠাট্টার মুখে ছদ্মগাম্ভীর্য ঝুলিয়ে বিনোদ বলছেন, “দশতলা বাড়ি নেই, তবে সিঁড়ি আছে!”
কী রে, তুই তো শেষমেশ শিল্পপতি হয়ে গেলি!
বাগবাজারে গিরীশ মঞ্চের উল্টো দিকে মোহন সেনকেও ঘিরে ধরেছেন ফচ্কে বন্ধুর দল। মুচকি হেসে তিনি বললেন, “টালিগঞ্জ-টঞ্জ থেকে এখানে নাটক দেখতে এসে লোকজন গপগপিয়ে তিন-চার টাকার বেগুনি-পেঁয়াজি খায়! তারিফ করে...আমি ভাবি, আর ক’দ্দিন চালাতে পারব।”
আগে ছেলেপুলে বখে গেলে বা পড়াশোনা না করলে বাবারা বলতেন, ব্যাটা চপ ভাজছে। মুখ্যমন্ত্রী এমন সম্মান দেওয়ার পরে কারও কি এ সব বলতে স্পর্ধা হবে? ঠাট্টা শুনতে শুনতেই মোহন তাঁর দোকান দেখাচ্ছিলেন। দু’জন কারিগর। আর কালিঝুলিমাখা একটি ভাড়ার ঘর। তাতেই তেলেভাজার উৎপাদন ও বিপণন। এই নিয়ে ‘শিল্পপতি’ মোহনের কোম্পানি। ৪৫ বছরের মোহনবাবু অকৃতদার। মাথা চুলকে বললেন, “বিয়ের সাহস পেলাম না।” কেন? “কারিগরের আকাল। ক’টা টাকাই বা মাইনে দিতে পারি!”
বাগবাজারেই তেলেভাজা-দম্পতি দিলীপ ও ইতু সরকারের অবশ্য ‘লেবার-কস্ট’ নেই। বিনোদ সাউদের মতো তাঁরাও নিজেরাই তেলেভাজা বানান। মাস গেলে টেনেটুনে আসে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা। তাঁদের মেয়ে কলেজে পড়ছেন। ছেলে কঠিন অসুখে আক্রান্ত। ছেলের চিকিৎসা, মেয়ের ভবিষ্যৎ সবই কেয়ার অব তেলেভাজা। ইতুদেবী স্বামীকে ডেকে ভয়ে-ভয়ে বলছেন, “সে কী গো, আমরাও নাকি শিল্পপতি!”
কিন্তু তেলেভাজার শিল্প হতে সমস্যাটা কই? বহুজাতিক পিৎজা-বার্গার বা ফ্রায়েড চিকেন পারলে তেলেভাজা পারবে না কেন? শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া শুনে বলছেন, “শেফরা বলতে পারবেন। আমার ঠিক ভাবা হয়নি এটা।” জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ চেন-এর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “বিষয়টি নিয়ে ঢালাও বিপণন দরকার। পরিকল্পনামাফিক এগোলে সাফল্য আসতে পারে।” তবে চিরকেলে তেলেভাজাকে নিয়ে নতুন কিছু করার উৎসাহ কই? কলকাতার নতুন ধাঁচের একটি বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁর কর্তা জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “দক্ষিণ কলকাতায় কিন্তু অনেকেই তেলেভাজা খেতে চান না। রাস্তার ধারের তেলেভাজা নিয়ে অম্বলের ভয়ে অভক্তিও আছে। সেটা দূর করা কঠিন।”
কিন্তু ভুজিয়াওয়ালারা তো পেরেছেন। দেশ জুড়ে ব্র্যান্ডকে ছড়াতে তাঁরা অনেকেই সফল। তেলে-ভাজিয়েরা বলছেন, লাড্ডু-বরফি-ভুজিয়া আলাদা। ও সব অনেক দিন থাকে। “তেলেভাজা হাতে-গরম ভেজে না দিলে লোকের মুখে রুচবে না,” বলছেন নেতাজিনগরের প্রাক্তন তেলেভাজা-কারবারি চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “নগদের ব্যবসা। সারা ক্ষণ নজরদারি চালাতে হয়। কারখানা থেকে সরবরাহ করলেও চলবে না। তাই অন্য ব্যবসায় সরে গেলাম।” চন্দনবাবুর ব্যাখ্যা, বিস্তর কারিগর রেখে একাধিক শাখা খুলে তেলেভাজার ব্যবসা করতে রেস্তর জোর দরকার।
তিন পুরুষের তেলেভাজা-কারবারে রসিকজনের সম্ভ্রম আদায় করা লক্ষ্মীনারায়ণের কর্তারাও বলছেন, তেল-আনাজের দাম যে হারে বাড়ে, তেলেভাজার দাম তত হলে লোকে কিনবে না। নামী দোকানের সব থেকে দামি আইটেমও আট টাকার বেশি নয়।
তবু দশতলা বাড়ি না-হলেও পরিশ্রম করে তেলেভাজাতেই তাঁরা লক্ষ্মীর মুখ দেখেছেন। সাউ ভাইদের এ বার আবদার, মুখ্যমন্ত্রী বরং নবান্নে অতিথি-আপ্যায়নেও তেলেভাজাকে মর্যাদা দিন। বিমান বসু থেকে হিলারি ক্লিন্টন বা ওবামা যে-ই আসুন না কেন, তেলেভাজা তাঁদের মুখে রুচবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy