ক্যামেরা খুলতেই আপত্তির আঙুল। বুধবার ভাঙড়ে আরাবুল ইসলামের বাড়ির সামনে। —নিজস্ব চিত্র
দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও আরাবুল ইসলামকে ছোঁয়নি প্রশাসন। ভাঙড়ে নিহত রমেশ ঘোষালের পরিবারের পক্ষ থেকে বুধবার সদ্য-বিতাড়িত তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার পরেও পুলিশ-প্রশাসন নড়েচড়ে বসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর। কারণ, তৃণমূলের ইতিহাস বলছে, তাদের নেতা-বিধায়করা বিরোধীদের উপর হামলা, পুলিশকে আক্রমণ, সরকারি কর্মচারীকে হেনস্থা করলেও পুলিশ এফআইআর করে না। আদালতের নির্দেশে অভিযোগ দায়ের হলেও নির্বিকার থাকে তারা।
উদাহরণ বিস্তর। অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলাম, তাপস পালদের নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে তোলপাড় হয়েছে। দীপালি সাহা, উষারানি মণ্ডল, অসীমা পাত্র বা ধীমান রায়রাও কম যান না। গত মে মাসে লোকসভা ভোটের সময় বুথে ঢুকে তাণ্ডব চালানো এমনকী খোদ প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে। আর মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক উষারানি মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বুথমুখী সিপিএম সমর্থকদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর। এই দু’জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দায়ের করে নির্বাচন কমিশন। দুই বিধায়কই গা-ঢাকা দেন। তাঁদের ধরার চেষ্টা করেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ। দীর্ঘদিন অধরা থাকার পরে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেন দীপালি। আর আদালতে গিয়ে আগাম জামিন পান উষারানি।
হাবরার বিধায়ক ধীমান রায় বা ধনেখালির বিধায়ক অসীমা পাত্রের ক্ষেত্রেও পুলিশ একই রকম উদাসীনতা দেখিয়েছে। লোকসভা ভোটের প্রচারের সময়েই ধীমানবাবুর বিরুদ্ধে বিডিও-কে নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশ বিধায়ককে জিজ্ঞাসাবাদ করার বাইরে এক পা-ও এগোয়নি। তারও আগে ধনেখালিতে পুলিশ হেফাজতে তৃণমূল কর্মী নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন অসীমা পাত্র। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা পর্বের পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই ঘটনার সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু দলীয় স্তরে অসীমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরস্থান, তাঁর উপরে আস্থা বাড়িয়ে তাঁকে পরিষদীয় সচিব করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এই সব উদাহরণ কয়েক জন পরিচিত জনপ্রতিনিধির মাত্র। নানা জেলায় পঞ্চায়েতে শাসক দলের বহু পদাধিকারী বা পুরসভার কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠছে রোজ। খাস কলকাতায় পুলিশ খুনে অভিযুক্ত মহম্মদ ইকবাল (মুন্না) যেমন। কিছু দিন কারাবাসের পরে জামিনে মুক্ত কাউন্সিলরকে বরো চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরালেও তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় স্তরে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যতিক্রম বলতে আর এক কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাউ। খুনের অভিযোগে তিনি এখনও জেলবন্দি (যদিও দল থেকে বহিষ্কার হননি)। আর রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষ। সারদা-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া কুণালকে সাসপেন্ড করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। যদিও দলের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে মুখ খোলাতেই এই শাস্তির খাঁড়া বলে তৃণমূলেরই অন্দরের ব্যাখ্যা।
নেতা-বিধায়কদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠলেও কেন ব্যবস্থা নেয় না দল? প্রশাসনই বা কেন নড়েচড়ে না-বসে শাসক দলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে?
তৃণমূলের তরফে বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “দল ঠিক সময়ে যার বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়ার, নেবে। এফআইআর হলেই তো সে দল-বিরোধী হয় না। অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে তো চার-পাঁচটি এফআইআর আছে। অমিত শাহকে এফআইআরের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল!”
তা হলে আরাবুলের ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রমী হলো দল? তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “বৃহত্তর স্বার্থেই আরাবুলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আরাবুলদের কাজে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছিল। ক্ষতি হচ্ছিল।” তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে একান্ত বাধ্য হয়েই আরাবুলকে বহিষ্কার করতে হয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা এখনও দেখা দেয়নি। তাই দল চুপ।
কিন্তু এই সব নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েও পুলিশ নির্বিকার কেন? পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবুর জবাব, “সিপিএম ফরওয়ার্ড ব্লক, বিজেপি বা কংগ্রেসের কথায় তো প্রশাসন ফাঁসি দিতে পারবে না! আইন যা বলবে, তা-ই হবে।” রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। তবে স্বরাষ্ট্র দফতরের এক আধিকারিকের দাবি, “সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা হয়েছে।” উদাহরণ হিসেবে রেজ্জাক মোল্লাকে মারধরের ঘটনায় আরাবুলকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ টেনেছেন তিনি। সে বার এফআইআরের উপর ভিত্তি করেই আরাবুলকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আদালত থেকে তিনি জামিন পান। তৃণমূলেরও যুক্তি, আদালত যদি জামিন দেয়, তা হলে সরকার কী করতে পারে। যদিও প্রশাসনেরই একাংশের বক্তব্য, পুলিশ কী ভাবে মামলা সাজাচ্ছে, তার উপরেই অনেকটা নির্ভর করে জামিন পাওয়া না-পাওয়া। পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকা বোঝাতে পাড়ুই-কাণ্ডে গ্রেফতারের কথাও বলেছেন ওই আধিকারিক।
বিরোধীরা অবশ্য প্রশাসনের এমন দাবি মানতে নারাজ। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বুধবার বলেছেন, “আরাবুলের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ, পুলিশ বা বিরোধী— যে কোনও কাউকে আক্রমণ করলে সাত খুন মাফ! শুধু তৃণমূলকে মারলে তবেই শাস্তি হবে!”
একই ভাবে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, “তৃণমূল ব্যবস্থা নিতে গেলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে! কাউকে ধরলে সে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট এবং তার আশপাশের বাসিন্দা বা আত্মীয়দের নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy