Advertisement
১৬ মে ২০২৪

বঙ্গে তারকা-প্রার্থীদের রমরমা কি দক্ষিণী রাজনীতিরই পদধ্বনি

দক্ষিণের তারকাদের রাজনীতিতে প্রবেশের সঙ্গে এই বঙ্গের নক্ষত্রদের অন্তর্ভুক্তির প্রেক্ষিত আলাদা। বাংলায় বর্তমানে তৃণমূলে যে তারকারা প্রবেশ করেছেন তাঁদের কিন্তু ‘অতিথি’ করেই রাখা হচ্ছে। লিখছেন সঞ্জয় সিংহ। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য।

সঞ্জয় সিংহ
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৪ ১৬:১০
Share: Save:

দক্ষিণের পথ ধরে উত্তরে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল আগেই। এ বারে ভোটে তা রীতিমতো ঝড় তুলেছে বঙ্গে!

দক্ষিণী রাজনীতিতে এমজি রামচন্দ্রন, এম করুণানিধি অথবা এনটি রামরাও, জয়ললিতা, জয়া প্রদারা চলচ্চিত্র দুনিয়া থেকে রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করে এক সময়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসও সুনীল দত্ত, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খন্না, গোবিন্দ, রাজ বব্বরদের দিয়ে বাজিমাতের চেষ্টা করেছে। এমনকী, এই বঙ্গেও কমিউনিস্টরা ভোট বৈতরণী পেরোতে অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমারদের প্রার্থী করেছেন। কিন্তু অনুপবাবু বা অনিলবাবুরা সকলেই বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে গণনাট্য সঙ্ঘের কাজকর্মের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ সুস্পষ্ট ছিল। দক্ষিণে রামচন্দ্রন বা করুণানিধিরা কিন্তু পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের কেন্দ্র করেই তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে রাজনীতি আবর্তিত হয়েছিল। তাঁরা নিজেরাই নতুন রাজনৈতিক দলগুলির নিউক্লিয়াস হয়েছিলেন।

দেব

ভাইচুং

সন্ধ্যা রায়

নিমু ভৌমিক

জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

জর্জ বেকার

মুনমুন সেন

পিসি সরকার
(জুনিয়র)

এ বার বঙ্গ রাজনীতিতে তারকা বা সেলিব্রিটিদের প্রার্থী হওয়াটা কিন্তু দক্ষিণী রাজনীতি-সংস্কৃতির মতো নয়। এ বঙ্গে তারকাদের রাজনীতিতে আসা নতুন নয় ঠিকই, কিন্তু এ বার সংখ্যা ও বৈচিত্রে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তৃণমূল এবং বিজেপি। জর্জ বেকার, জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বা নিমু ভৌমিকের মতো অস্তমিত তারকাদের প্রার্থী করেছে বিজেপি। তাঁদের টেক্কা দিতে তৃণমূল প্রার্থী করেছে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা বাংলা ছবির নায়ক দেবকে। তাঁর সঙ্গে রেখেছে এখনও গ্ল্যামার অটুট রাখা মুনমুন সেন এবং ‘বাবা তারকনাথ’ খ্যাত সন্ধ্যা রায়কে। বিজেপি-র যেমন জাদুকর পিসি সরকার, গায়ক বাবুল সুপ্রিয়, তৃণমূলেরও তেমনই ফুটবলার ভাইচুং ভুটিয়া, গায়ক ইন্দ্রনীল সেন বা অভিনেত্রী অর্পিতা ঘোষ প্রমুখ আছেন।

দক্ষিণের তারকাদের রাজনীতিতে প্রবেশের সঙ্গে এই বঙ্গের নক্ষত্রদের অন্তর্ভুক্তির প্রেক্ষিত আলাদা। তামিলনাড়ুতে ১৯৬২ সালে কংগ্রেস বিরোধী শক্তি তৈরিতে রামচন্দ্রন আসরে নেমেছিলেন। চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচিত করুণানিধিও টিনসেল টাউনকে ‘রাম রাম’ করে দ্রাবিড় রাজনীতির উন্মেষ ঘটাতে সর্ব ক্ষণের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পরে অমিতাভ বচ্চনের ইলাহাবাদ থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে দাঁড়ানো বা তার পরবর্তী কালে রাজেশ খন্নার কংগ্রেস প্রার্থী হওয়াটা দক্ষিণী রামরাও, রামচন্দ্রনের মতো নয়। তবে বিজেপি-র শত্রুঘ্ন সিংহ, স্মৃতি ইরানি, সমাজবাদী পার্টির জয়া বচ্চন প্রমুখ কিন্তু নিছক তাঁদের দলে ‘অতিথি শিল্পী’ হয়ে যাননি। পুরোদমে রাজনীতি করছেন।

সৌমিত্র রায়

ইন্দ্রনীল সেন

তাপস পাল

শতাব্দী রায়

মিঠুন চক্রবর্তী

দেবশ্রী রায়

অর্পিতা ঘোষ

বাংলায় বর্তমানে তৃণমূলে যে তারকারা প্রবেশ করেছেন তাঁদের কিন্তু ‘অতিথি’ করেই রাখা হচ্ছে। এর আগে তৃণমূলে তাপস পাল, শতাব্দী রায় সাংসদ হয়েছেন। এ বারেও তাঁরা প্রার্থী আছেন। এর আগে গত বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী করে জিতিয়ে নিয়ে এসেছেন দেবশ্রী রায়, চিরঞ্জীবের মতো অভিনেত্রী-অভিনেতাদের। জিতিয়ে এনেছেন গায়ক অনুপ ঘোষালকে। কিন্তু এঁরা সকলেই তাঁর দলে ‘অতিথি।’ সদ্য রাজ্যসভার ভোটে মিঠুন চক্রবর্তীকে প্রার্থী করে মমতা দিল্লি পাঠিয়েছেন। এ বার লোকসভা ভোটে দেব, মুনমুন, সন্ধ্যা রায়েদের প্রার্থী করেও মমতা জানিয়েছেন, “ওঁরা আমাদের দলে অতিথি। ওঁরা সাংস্কৃতিক জগতে যেমন কাজ করছেন, তেমনই করবেন। ওঁদের কাজে কোনও বিঘ্ন ঘটানো হবে না।”

আগের বার লোকসভা ভোটে যাদবপুরে তৃণমূলের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন গায়ক কবীর সুমন। তিনি কিন্তু ‘অতিথি’ হয়ে থাকেননি। একদা বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত কবীর সুমন পুরোপুরি রাজনীতির প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে গিয়ে দলীয় নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। তৃণমূলের অনেকেই ভেবেছিলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়! এ বার আর সেলবো নয়!’’ কিন্তু এ বার নয় নয় করে মমতা চার অভিনেতা-অভিনেত্রী, দুই নামী গায়ক, এক ফুটবলারকে প্রার্থী করে বলেছিলেন, “দিল্লিতে এ বার সরকার পরিবর্তন হবে। সেই সরকার গড়ার কাজে গতানুগতিক রাজনীতির হাত ধরে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে জনগণের সরকার তৈরি হবে।” পরে দেবকে দেখিয়ে বলেছেন, “তরুণদের এগিয়ে না দিলে উন্নয়ন হবে কী করে? তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করবে দেব।” সেই দেব, যিনি ব্রিগেডে তৃণমূলের শহিদ দিবসের সমাবেশে তাঁর অভিনীত ‘পাগলু’ ছবির গান গেয়ে নেচেছিলেন। মমতার আরও এক প্রার্থী, বাংলার একটি জনপ্রিয় ব্যান্ডের লিড গায়ক সৌমিত্র রায় ঢোল বাজিয়ে প্রচার করছেন মালদহে। বাংলা এমন প্রচার এর আগে দেখেনি!

সুনীল দত্ত

অমিতাভ বচ্চন

জয়া বচ্চন

রাজ বব্বর

চিরঞ্জীবী

রাজেশ খন্না

জয়াপ্রদা

গোবিন্দ

সেলিব্রিটিদের প্রার্থী করা নিয়ে তৃণমূল নেত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা নিয়ে দলের একাংশ অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক দলগুলি জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়েছিল তারকাদের হাত ধরেই। সে কথা মাথায় রেখেই এ বার প্রার্থী তালিকায় তারকা-বিন্যাস হয়েছে। অন্য অংশের মতে, দলনেত্রীর বিপুল জনপ্রিয়তায় দলের অনেকেই প্রার্থীর দাবিদার ছিলেন। তার উপর দলে অন্তর্দলীয় কোঁদলের রাজনীতিও রয়েছে। এই সমস্ত বিতর্ক প্রশমিত করতেই দেব-দের আমদানি করেছেন মমতা। তাঁদের কথায়, “দিদি, একদম নিউট্রাল প্রার্থী দিয়ে দিয়েছেন! কারও কিছু বলার থাকবে না।” বলার থাকবে, কি থাকবে না, তা অবশ্য ভবিষ্যত্‌ই বলবে।

এনটি রাম রাও

করুণানিধি

জয়ললিতা

অনিল চট্টোপাধ্যায়

অনুপ কুমার

বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়

অনুপ ঘোষাল

আর মমতা যে এমন চমক দেবেন তা আঁচ করে বিজেপি-ও চলচ্চিত্র থেকে বিনোদন জগতের ব্যক্তিত্বদের প্রার্থী করেছে। কিন্তু এটা করে বিজেপি-র উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে তা-ও অনুমানের বিষয়। কারণ, বীরভূমে তৃণমূলের শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে যে জয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজেপি প্রার্থী করেছে, কয়েক দিন আগেও তাঁকে ‘দিদি’র সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতে দেখা যেত। দিদি তাঁকে প্রার্থী করেননি। তাই বিজেপি-র প্রস্তাব লুফে নিয়েছেন ৪০টি বাংলা ছবির নায়ক জয়। আবার রায়গঞ্জে কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সির বিরুদ্ধে বিজেপি যে নিমু ভৌমিককে প্রার্থী করেছে, তাঁর পরিচিতি ছিল প্রয়াত সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর ‘স্নেহধন্য’ বলেই। সিপিএম তাঁকে মর্যাদা দেয়নি। অভিমানী নিমু তাই ‘নমো’র দলে ভিড়েছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যবধান তাঁর প্রার্থী হওয়ার পথে বাধা হয়নি।

লক্ষ্য করার বিষয়, দক্ষিণের সঙ্গে বাংলার এ বারের তারকা-প্রার্থীদের বড় তফাত্‌ রয়েছে। দক্ষিণের রামচন্দ্রন, জয়ললিতারা চলচ্চিত্র জগত্‌ ছেড়ে রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। দক্ষিণের বিজয়কান্ত, চিরঞ্জীবী বা বিজয়শান্তিরা প্রচারে চলচ্চিত্রের সংলাপের থেকে রাজনৈতিক বক্তব্যকেই মানুষের কাছে বলেছেন। তেলঙ্গনা রাজ্য হবে কি হবে না তা নিয়ে আলোচনায় বিজয়শান্তি তাঁর চলচ্চিত্র ইমেজকে পাত্তা দিতে চান না। এখানে কিন্তু সন্ধ্যা রায়ের জন্য মেদিনীপুর কেন্দ্রের তৃণমূল নেতাদের শিবের মন্দিরের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। কারণ, সন্ধ্যাদেবীর এখনও ‘বাবা তারকনাথ’-এর শিব ভক্ত নায়িকার ইমেজ কাজে লাগাতে হবে।

তফাত্‌টা এখানেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

special issue sanjoy sinha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE