Advertisement
০১ জুন ২০২৪

লাইসেন্স নেই, সোনার দোকানে ঢালাও অ্যাসিড

ঘাটাল শহরের নিউ মার্কেটের একটি মার্কেট কমপ্লেক্সে সোনা-রুপোর দোকান। ঢুকতেই দেখা গেল, সোনার গয়নার উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য তরল কিছু ব্যবহার করছেন কারিগরেরা। কী এটা? সালফিউরিক অ্যাসিড। দোকানের এক কোণে ছোট কাঁচের শিশিতে রয়েছে সেই অ্যাসিড। লাইসেন্স আছে তো?

নুরুল আবসার ও অভিজিৎ চক্রবর্তী
ডোমজুড় ও ঘাটাল শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩৪
Share: Save:

ঘাটাল শহরের নিউ মার্কেটের একটি মার্কেট কমপ্লেক্সে সোনা-রুপোর দোকান।

ঢুকতেই দেখা গেল, সোনার গয়নার উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য তরল কিছু ব্যবহার করছেন কারিগরেরা। কী এটা? সালফিউরিক অ্যাসিড। দোকানের এক কোণে ছোট কাঁচের শিশিতে রয়েছে সেই অ্যাসিড। লাইসেন্স আছে তো?

প্রশ্ন শুনেই ঘাবড়ে গেলেন দোকানের মালিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোকান মালিক বলেন, “আমরা অল্প পরিমাণে অ্যাসিড রাখি। তা ব্যবহার করলে লাইসেন্স প্রয়োজন, এই তথ্য আমাদের জানা নেই।” ঘাটাল ছাড়াও আরও যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে সোনার দোকান রয়েছে তা হল হাওড়ার ডোমজুড়। একই চিত্র দেখা গেল এই এলাকাতেও। এখানে একটি সোনার দোকানে চলছে স্বর্ণালঙ্কার পালিশের কাজ। অন্তত আট জন কারিগর কাজে ব্যস্ত। পালিশের কাজ হচ্ছে সালফিউরিক অ্যাসিডের সাহায্যে। দোকানির বক্তব্য, এইভাবেই তাঁর দোকানে সোনা পালিশের কাজ হয়। এছাড়াও নাইট্রিক অ্যাসিডও তাঁর লাগে বলে ওই দোকানি জানান। এই অ্যাসিড লাগে সোনা গালানোর কাজে। কোথা থেকে পেয়ে থাকেন এই অ্যাসিড? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এই দোকানি জানালেন, ডোমজুড়েই রয়েছে সোনার কাজ করার জন্য যে সব জিনিসপত্র লাগে তার ব্যবসা। এইরকম একাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকেই মেলে অ্যাসিড। ওই দোকানি জানালেন মাসে তাঁর মোট দু’বোতল অ্যাসিড লাগে। এক বোতল সালফিউরিক ও এক বোতল নাইট্রিক অ্যাসিড। একেকটি বোতলে থাকে এক লিটার করে অ্যাসিড।

শুধু সোনার দোকানেই নয়, সোনা গালাইয়ের জন্য রয়েছে একাধিক কারখানাও। দাসপুরের এক গালাই কারখানার মালিক বাসু মান্না বলেন, “আমাদের কাছে অনেক সোনার দোকানের মালিকেরাই কাজ দিয়ে যায়। সোনা গালানোর জন্য অ্যাসিড তো লাগবেই। তবে এর জন্য লাইসেন্স লাগবে, তা জানা নেই। কেউ কোনও দিন দোকানে আসেওনি।” ঘাটাল শহরে সোনার দোকান অসিত অধিকারীর। সেখানেও সার দিয়ে রাখা অ্যাসিডের বোতল। তাঁরও কোনও লাইসেন্স নেই। অসিতবাবুর বক্তব্য, “আমাদের ছোট দোকান চালাতে গেলে অ্যাসিড তো লাগবেই। প্রশাসনই আমাদের লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দিক। তা হলে বিনা লাইসেন্সে আর অ্যাসিড রাখব না।”

যত্রতত্র অ্যাসিড ব্যবহার ও লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড বিক্রি করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার রায়ে অ্যাসিড বিক্রি ও তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিষয়ে নতুন নির্দেশ জারি করেছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারও সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের উপর একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে। তাতে মহকুমা পুলিশ অফিসার ও মহকুমা স্তরের ম্যাজিস্ট্রেটদের হাতে অবাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, প্রচারের অভাব এবং পুলিশ-প্রশাসন অভিযান না চালানোর ফলে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। ঘাটালের মহকুমাশাসক অদীপ রায় বলেন, “পুলিশকে বিষয়টিতে কড়া নজরদারি চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” কিন্তু তার পরেও ছবিটা খুব একটা বদলায়নি।

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় ছোট-বড় মিলিয়ে আনুমানিক শ’পাঁচেক সোনা-রুপোর দোকান রয়েছে। গালাই কারখানাও রয়েছে সাত-আটটি। আইনের তোয়াক্কা না করে অলিতে-গলিতে বিকোচ্ছে অ্যাসিড। ঘাটাল শহর ছাড়াও দাসপুর, সাগরপুর, বেলেঘাটা, নাড়াজোলের মতো বিভিন্ন জায়গায় কয়েকশো সোনার দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানেই অ্যাসিড থাকে। অন্যদিকে ডোমজুড়ে সোনার দোকান রয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার। তাঁদের কাছে অ্যাসিড বিক্রি করেন এমন দোকানদার রয়েছেন কয়েকশো। অ্যাসিড ব্যবহার নিয়ে করণীয় কী তা জানিয়ে ডোমজুড় থানার কাছে আদালতের নির্দেশিকাও এসেছে। পুলিশের দাবি, সেই নির্দেশিকা মেনে হানাও দেওয়া হয় অ্যাসিডের দোকানে। যদিও দোকানদারেরা জানান, এইধরণের কোনও অভিযান তাঁরা দেখেননি। দোকানিরাই বরং এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করেন বলে জানালেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অ্যাসিড বিক্রেতার কথায়,“চেনা পরিচিত সোনার কারবারি ছাড়া আমরা কাউকে অ্যাসিড বিক্রি করি না।” তবে ঘাটালের এক পদস্থ পুলিশকর্তার দাবি, “সোনার দোকানে খুব কম পরিমাণে অ্যাসিড থাকে। গালাই কারখানায় বেশি অ্যাসিড মজুত থাকে। আমরা গোপনে তদন্ত শুরু করেছি।”

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অজয় কুমার মিশ্রের কথায়, “নাইট্রিক অ্যাসিড শরীরে পড়লে চামড়ার ব্যাপক ক্ষতি সঙ্গে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। বেশি মাত্রায় চোখে বা গলায় পড়লে মৃত্যুও হতে পারে। সোনার দোকানে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সালফিউরিক অ্যাসিডও ব্যবহার হয়। সোনার গয়না তৈরির পরে উজ্জ্বলতা আনতে দোকানিরা তা ব্যবহার করেন। নাইট্রিক অ্যাসিড এবং হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি হয় অ্যাকোয়া রিজিয়া। এটা সোনাকে খুব দ্রুত গলিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা খুবই মারাত্মক। যদি কারও শরীরের কোনও অংশে পড়ে, সেই অংশ বাদ দিতেও হতে পারে।”

অ্যাসিড ব্যবহার এবং দোকানে কম-বেশি অ্যাসিড রাখার কথা স্বীকারও করেছেন ঘাটাল স্বর্ণ ব্যবসয়ী সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক অধিকারী। তাঁর দাবি, “কোথা থেকে লাইসেন্স পাওয়া যাবে তা পরিষ্কার ভাবে আমাদের জানালে আমরা আবেদন করব। তবে আমরা সম্প্রতি বৈঠক করে কোনও পরিচিত বা অপরিচিত ব্যাক্তিকে অ্যাসিড দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছি।” একই দাবি করেন ডোমজুড় স্বর্ণ-রৌপ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nurul absar abhijit chakraborty acid
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE