Advertisement
২৫ মে ২০২৪

শিক্ষকদের উদ্যোগে ফিরল স্কুলছাত্রী

গত বছর দুয়েকে গ্রাম ও তার আশপাশ থেকে নিখোঁজ হয়েছে ছ’জন নাবালিকা। কেউ ফেরেনি। দিল্লি ও পুনের নিষিদ্ধপল্লীতে দু’জনের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু ফিরিয়ে আনা যায়নি। প্রতি মাসে তাই ছাত্রীদের নিয়ে বসতেন বাসন্তীর রামচন্দ্রখালি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুল ইসলাম। সঙ্গে অন্য শিক্ষকরাও। ছাত্রীদের বোঝাতেন, চাকরি, বিয়ের ফাঁদে পা দিয়ে বাইরে যাওয়ার বিপদ। তা সত্ত্বেও মাস দেড়েক আগে একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল নবম শ্রেণির আবিদা লস্কর (নাম পরিবর্তিত)।

বাঁ দিক থেকে জাফর ইকবাল ও আজিজুল ইসলাম।  —নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিক থেকে জাফর ইকবাল ও আজিজুল ইসলাম। —নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

গত বছর দুয়েকে গ্রাম ও তার আশপাশ থেকে নিখোঁজ হয়েছে ছ’জন নাবালিকা। কেউ ফেরেনি। দিল্লি ও পুনের নিষিদ্ধপল্লীতে দু’জনের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু ফিরিয়ে আনা যায়নি। প্রতি মাসে তাই ছাত্রীদের নিয়ে বসতেন বাসন্তীর রামচন্দ্রখালি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুল ইসলাম। সঙ্গে অন্য শিক্ষকরাও। ছাত্রীদের বোঝাতেন, চাকরি, বিয়ের ফাঁদে পা দিয়ে বাইরে যাওয়ার বিপদ। তা সত্ত্বেও মাস দেড়েক আগে একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল নবম শ্রেণির আবিদা লস্কর (নাম পরিবর্তিত)।

এলাকার লোকজন তেমন গা করেননি। কিন্তু মানতে পারছিলেন না শিক্ষকরা। আজিজুল বলেন, “মেয়েটার মা-বাবা যখন আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে এলেন, তখন ঠিক করলাম কিছু একটা করতেই হবে।” এগিয়ে এলেন অন্য শিক্ষকরাও, বিশেষত ইতিহাসের শিক্ষক জাফর ইকবাল। তাঁদের চেষ্টাতেই আবিদার পরিণতিটা অন্য রকম হয়েছে। ভিন্রাজ্যের নিষিদ্ধপল্লীতে ভয়াবহ দেড় মাস কাটিয়ে সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছে সে।

এই ক’টা দিন দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে আবিদার পরিবারের। ২৬ এপ্রিল মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার তিন দিনের মাথায় প্রথম ফোন আসে বাড়িতে। কাঁদতে কাঁদতে আবিদা বলেছিল, “ওরা আমাকে দিল্লিতে আটকে রেখেছে। বিক্রি করে দেবে বলছে। তোমরা বাঁচাও।” দিন কয়েক পরে অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন করে সে। জানায়, গাজিয়াবাদে একটি বাড়িতে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলছে। বাসন্তী থানার পুলিশকে জানালে তারা কোনও উদ্যোগ নেয়নি, অভিযোগ পরিবারের।

জাফর ইকবাল তখন তাঁর পরিচিত এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি দিল্লি পুলিশের সঙ্গে, এবং দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবীর সংস্থার সঙ্গেও কথা হয়। ওই সংস্থার সঙ্গেই দিল্লি যান আবিদার বাবা। নানা নিষিদ্ধপল্লীতে তল্লাশি করেও খোঁজ মেলেনি আবিদার। হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরার দিন কয়েক পরে ফের ফোন আসে। আবিদা ফোনে জানায়, সে এক জায়গায় কাজ করছে। মাস শেষ হলে মাইনে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

জাফর জানান, ওই ফোনটা পেয়ে তাঁদের সন্দেহ হয় যে জোর করে আবিদাকে দিয়ে ওই সব বলানো হচ্ছে। তাঁরা দক্ষিণ ২৪ পরগণার পুলিশকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১৩ জুন ক্যানিংয়ে আবিদাকে পৌঁছে দিয়ে যায় কেউ। খবর পেয়ে আবিদার বাবা এবং জাফর ক্যানিং থেকে তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। আবিদার বাবা বলেন, “মেয়েটা কোনও কথা বলছিল না। শুধু থরথর করে কাঁপছিল।” অসুস্থ, শীর্ণকায় আবিদার দায়িত্ব নিয়েছে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি। সে এখন স্থানীয় একটি হোমে ভর্তি। আগামী সপ্তাহে তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট হবে।

দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির তরফে সুবীর রায় বলেন, “দিল্লির নিষিদ্ধ পল্লীতে মেয়ে পাচারের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই সবচেয়ে বেশি। বিশেষত দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তরবঙ্গ।” তল্লাশির সময়ে নাবালিকাদের লুকিয়ে ফেললেও, মোবাইলের সূত্র ধরে খোঁজাখুঁজি জারি রাখলে পাচারকারীরা মেয়েদের অনেক সময়ে ফিরিয়ে দেয়। আবিদার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, আন্দাজ তাঁর।

আবিদাকে ফিরে পেয়ে আশ্বস্ত হলেও, পুলিশের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ তার পরিবার। তাঁদের অভিযোগ, দিল্লি ্থেকে আবিদার ফোনের কথা জানানো হলে পুলিশ বলে, ভোট না মিটলে কিছু করা যাবে না। আগাগোড়া তৎপরতা দেখায়নি পুলিশ। অথচ আবিদার বাড়ি ফেরার খবর পেয়েই তারা বারবার আবিদাকে থানায় ডেকে পাঠায়। আবিদার বাবার অভিযোগ, “আমি পুলিশকে বললাম, আপনারা তো উদ্ধার করেননি। ও নিজেই ফিরেছে। এ বার বাড়ি এসে ওর কাছে যা জানার তা জেনে নিন। তাতে উল্টে ওরা অপবাদ দিল, আমিই নাকি মেয়েকে বিক্রি করেছিলাম।”

জেলার পুলিশকর্তারা অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁদের দাবি, তাঁরা পাশে না থাকলে দিল্লি পুলিশ কিছু করত না। মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশন জেলা পুলিশই দিয়েছিল। “ভোটের জন্য কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম, সেটা ঠিক। আমরা উদ্ধার করার আগে ও ফিরে এসেছে এটা আনন্দের কথা, কিন্তু আমরাও হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলাম না,” বলেন জেলার এক পুলিশকর্তা।

তবু পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। হোমে বসে বৃহস্পতিবার আবিদা যা বলেছে, তাতে স্পষ্ট যে তার স্কুলের এক সহপাঠিনীর হাত ছিল তার পাচারে। বিয়ের পর সেই মেয়ে নিখোঁজ হলেও, সম্প্রতি স্বামীর সঙ্গে এলাকায় ফিরে এসেছিল। তার দেওয়া চকোলেট খেয়ে বেহুঁশ আবিদার জ্ঞান ফেরে একটা অচেনা বাড়িতে। বেশ কয়েকটা এলাকা বদলে রাখা হয়েছিল তাকে। প্রতিটি জায়গাতেই প্রতিদিন বারবার ধর্ষিতা হয়েছে সে।

এর অর্থ, নিখোঁজ হয়ে যৌনব্যবসায় নামা মেয়েরা নতুন চক্র শুরু করছে। নিষিদ্ধপল্লীতে মেয়ে বিক্রির যত ঘটনা ঘটছে দেশে, তার অর্ধেকের বেশি ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। নাবালিকা পাচারে মোট নথিভূক্ত ঘটনার ৪৫ শতাংশ এ রাজ্যের। অথচ এই সব অপরাধে গ্রেফতার ও শাস্তির ঘটনা মাত্র চার শতাংশ, যা দেশে সব চাইতে কম। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে, পুলিশের গাফিলতির সুযোগেই রাজ্যে পাচারচক্র সক্রিয় হতে পারছে।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান সুবীরবাবু বলেন, “বাসন্তী থানার পুলিশের উচিত অবিলম্বে মেয়েটিকে নিয়ে দিল্লিতে আসা। কারণ যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, সেই এলাকাগুলি মেয়েটি চিনিয়ে দিলে তবেই অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব। না হলে মেয়েটিকে সুবিচার দেওয়া যাবে না।” তাঁরা কি দিল্লি যাবেন? বাসন্তী থানার পুলিশ জানায়, তদন্ত চলছে। এখনই বলা যাবে না।

দিল্লি পরের কথা। আপাতত সবাই দিন গুনছে, কবে আইনি জটিলতা কাটিয়ে হোম থেকে বাড়ি ফিরবে আবিদা। মেয়ে ফিরলে ফের তাকে স্কুলে পাঠাবেন তো? কাঁদতে কাঁদতে আবিদার মা বললেন, “ওঁরাই তো মেয়েটাকে ফেরালেন। ওঁদের কাছেই ও নিরাপদে থাকবে।”

কী বলছেন শিক্ষকরা? ম্লান হেসে জাফর বলেন, “যে মেয়েটিকে পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা সন্দেহ করছি, সে-ও তো এক সময়ে আমাদেরই ছাত্রী ছিল। দায় এড়াই কী ভাবে? আমাদের শিক্ষায় গাফিলতি হয়তো থেকে গিয়েছে। আপাতত আমরা চাই আবিদা স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE