ভিতরে সৌজন্যের প্রতিমূর্তি। বাইরে রণংদেহি।
দু’রকম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আজ দেখল সংসদ ভবন! সেন্ট্রাল হলে যে মমতা হাসিমুখে কথা বলেছেন বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে, কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন, সেই মমতাই সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তোপ দেগেছেন কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে। সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত নিয়ে। যা দেখে রাজধানীর রাজনীতিকরা মিটিমিটি হেসে বলছেন, মান বাঁচাতে কোণঠাসা তৃণমূল নেত্রীর আর কী-ই বা করার ছিল!
মমতা গোড়ায় বলেছিলেন, সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্না দিতে দিল্লি যাবেন তিনি। পরে সুর পাল্টে জানান দিল্লি যাচ্ছেন অসুস্থ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সারদার ছায়া কি পিছু ছাড়ে? সারদা কাণ্ডে একের পর এক তাঁর দলের নেতাদের গ্রেফতারি নিয়ে মমতা কী বলেন, তা শুনতেই আজ সংসদ ভবনের বাইরে ভিড় জমিয়েছিল জাতীয় সংবাদমাধ্যম।
দুপুর বারোটা নাগাদ মমতা সংসদ চত্বরে এলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত সাংসদ সুব্রত বক্সী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খানের মতো সাংসদেরা ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান তোলেন। লক্ষণীয় ভাবে তখন হাজির ছিলেন না মুকুল রায়। পরে অবশ্য নেত্রীর পাশে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যেই মমতা এগিয়ে যান অপেক্ষারত মাইকের দিকে। নিজস্ব ঢংয়ে বলেন, “চোরের মায়ের বড় গলা! দিল্লিতে পিএসিএল চিটফান্ড ৪,৯০০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করেছে। কিন্তু সিবিআই হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কাউকে গ্রেফতার করছে না। প্রশ্ন করলে বলছে ওরা তদন্তে সহযোগিতা করছে। তা হলে আমাদের সাংসদেরা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা সত্ত্বেও তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে কেন?’’
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সিবিআই আমাদের নেতাদের জেলে ঢোকাচ্ছে। স্বৈরাচারীর মতো ব্যবহার করছে। আসলে আমরাই এক মাত্র দল যারা বিজেপি-র সঙ্গে লড়াই করছি। তাই ওরা সন্ত্রস্ত। কেন্দ্র আমাদের বুলডোজ করতে চাইছে। কলকাতায় গিয়ে ওরা বলছেন মমতা ভাগ, মুকুল ভাগ। আমরা বাংলার ভূমি পুত্র-কন্যা। কেউ জমি ছেড়ে কোথাও পালাবে না।”
যে সিবিআই তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলছে আজ সেই গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি, জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, নন্দীগ্রাম, নেতাই-- প্রত্যেকটি তদন্তের কথা উল্লেখ করে মমতার তোপ কোথাও সিবিআই কিছু করেনি। তাঁর কথায়, “অথচ সারদা কেলেঙ্কারির মূল ব্যক্তিকে আমরা কাশ্মীর থেকে গ্রেফতার করেছি। পাঁচ লক্ষ লোককে অর্থ ফেরত দিয়েছি।”
কিন্তু সংসদের ভিতরে গিয়েই বদলে গেল চিত্রটা। বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও মিষ্টি সুরে কথা বললেন মমতা। মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে দেখে আঁতকে উঠে বলেন, “এ কী আপনার চেহারা এত খারাপ হয়ে গেল কী করে?” বেঙ্কাইয়া জানান, সম্প্রতি তাঁর গ্যাসট্রিক অপারেশন হয়েছে, তা ছাড়া ডায়াবেটিসের সমস্যাও রয়েছে।
গত লোকসভা ভোটে আসানসোলে যে বাবুল সুপ্রিয়কে হারানোর জন্য মরিয়া পণ করেছিলেন মমতা, বাবুল মন্ত্রী হওয়ার পরে কার্যত ফতোয়া জারি করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেননি রাজ্যের আমলাদের, সেই বাবুলের গানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ছাড়পত্র দিয়ে দেন দলীয় সাংসদদের। জানিয়ে দেন, সময় থাকলে নিজেও যেতেন।
তৃণমূল শিবিরের একাংশের মতে, এই নরম অবস্থানই এ বারের দিল্লি সফরে দলনেত্রীর আসল সুর। কড়া ভাষণটা নেহাতই মান বাঁচাতে। বিশেষ বিশেষ সময় মমতার পাশে মুকুলের অনুপস্থিতিও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন তৃণমূলের ওই নেতারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, গত কাল মমতাকে আনতে বিমানবন্দরে আলাদা আলাদা ভাবে গাড়ি পাঠান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়। মুকুলের গাড়ি পাঠানো অভিষেক ভাল চোখে দেখেননি। সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের ফাঁস শক্ত হওয়ার পর থেকেই মুকুলকে সরিয়ে অভিষেকই ক্রমশ দিদির মুখ হয়ে উঠছেন। আজ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে যাওয়ার সময় মমতার সঙ্গী ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন ও অভিষেক। মুকুলের ডাক পড়েনি।
সারদা-তদন্ত শুরু হওয়ার পরে আরও এক বার দিল্লি এসে বিজেপির সঙ্গে ‘নরম’ হওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন মমতা। সে যাত্রা লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন। পরে দেখা করেছিলেন অরুণ জেটলি ও রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও। কিন্তু তাতে সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্তের তীব্রতা কমেনি। এ বারও মমতার ‘নরম’ হওয়ার নীতিতে চিঁড়ে ভিজবে না বলেই ইঙ্গিত কেন্দ্রের শাসক দলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy