Advertisement
১৬ মে ২০২৪

১৭ ঘণ্টার যন্ত্রণা ঠেলে মা উজ্জ্বল ‘প্রকৃতি’র আলোয়

ধ্বংস আর সৃষ্টির লগ্ন এমন একাকার হয়ে যাবে, কে জানত! নতুন অতিথি যে আসছে, সে তো জানা কথাই! তবে কবে আসবে, তা নিয়ে ছিটেফোঁটা ভাবেইনি শোরপানির অখ্যাত গাঁয়ের গুরুঙ্গ পরিবার। হাসিখুশি হবু মাকে ডাক্তার দেখানো হয়নি এক বারও। ডাকাবুকো গোর্খালি অষ্টাদশী সুনকুমারী গুরুঙ্গেরও এ সব নিয়ে ভাবতে বয়েই গিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার রেওয়াজ তেমন নেই এ তল্লাটে।

মেয়েকে কোলে নিয়ে সুনকুমারী গুরুঙ্গ। গোর্খা হাসপাতালে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

মেয়েকে কোলে নিয়ে সুনকুমারী গুরুঙ্গ। গোর্খা হাসপাতালে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

ঋজু বসু
হরম টারিচক (গোর্খা, নেপাল) শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৪:০৪
Share: Save:

ধ্বংস আর সৃষ্টির লগ্ন এমন একাকার হয়ে যাবে, কে জানত!

নতুন অতিথি যে আসছে, সে তো জানা কথাই! তবে কবে আসবে, তা নিয়ে ছিটেফোঁটা ভাবেইনি শোরপানির অখ্যাত গাঁয়ের গুরুঙ্গ পরিবার। হাসিখুশি হবু মাকে ডাক্তার দেখানো হয়নি এক বারও। ডাকাবুকো গোর্খালি অষ্টাদশী সুনকুমারী গুরুঙ্গেরও এ সব নিয়ে ভাবতে বয়েই গিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার রেওয়াজ তেমন নেই এ তল্লাটে। প্রান্তিক সিমফু গ্রাম থেকে দিনভর পাহাড় ভেঙে গ্রামীণ অঞ্চলের সদর (ভিডিসি) শোরপানিতে ঢুকে কে-ই বা ডাক্তারবাবুর কাছে যাবে।

এমনকী, শনিবারের সেই সকালে, পেটের ভেতর বিচ্ছুটা ঝটপট হাত-পা ছুড়ছে টের পেয়েও বড় ননদ পূজাদিদিকে ডেকে শুধু খিলখিলিয়ে হেসেইছিলেন সুনকুমারী। তার পর রোজকার হেঁসেলের হাঁড়ি ঠেলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়া যে কে সেই। বেলা বারোটার সেই মহা ঝটকায় ছিটকে পড়েই বেড়ে গেল ব্যথাটা। পাথরের নীচে ঢুকে থাকা বাঁ পা-টা তখন নড়ানোরও ক্ষমতা নেই তাঁর। ধসে পড়েছিল গোটা মহল্লাই। চোখের সামনে পাশের বাড়ির তিন জন জ্যান্ত পাথরের কবরে। আর বার করা যায়নি তাঁদের। একটু হলেই পেটের বিচ্ছুটাকে সুদ্ধ হয়তো এক মুহূর্তে কবরেই যাওয়ার কথা ছিল সুনকুমারীর।

যেতে হয়নি! তার বদলে গোর্খা জেলার হরম টারি চক পুর এলাকায় এখন তাঁর তুলোর পুঁটলিটাকে নিয়ে হাসপাতালের নার্সদের কাড়াকাড়ি দেখছেন গর্বিত জননী। গোটা একটা দিন শরীরের খানিকটা ঢুকে গিয়ে পাথরে আটকে থেকেছেন তিনি। যখন প্রসববেদনা তুঙ্গে তখনও পা-টা বার করার জো নেই। সেটা শনিবার রাত ন’টা। ধ্বংসস্তূপে বন্দি দশাতেই তুলোর মতো মেয়েটার জন্ম দিয়েছেন সুনকুমারী। হাসপাতালের শিক্ষার্থী নার্স সীতা পুনওয়া মাথা খাটিয়ে একটা নামও বার করে ফেলেছেন দুর্যোগ-কন্যার। প্রকৃতি! প্রতিকূলতার উজান ঠেলে এমন লড়াইয়ের মোক্ষম নাম ‘প্রকৃতি’ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে!

বুধবার সকালে গোর্খা জেলা হাসপাতালের এইচ ব্লকের বেডে ‘প্রকৃতি’কে কোলে নিয়েই বসলেন সুনকুমারী। মঙ্গলবার বিকেলে কপ্টারের উড়ানে কোনওমতে এ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় সুনকুমারীকে। প্রসবের পর থেকে টানা রক্তক্ষরণে কাহিল। চিকিৎসার পরে এখন অনেকটা সুস্থ মা-মেয়ে। হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল সুপার সুধা দেবকোটা বলছিলেন, ‘‘দেড় বোতল রক্ত দিতে হয়েছে মেয়েটাকে। সাংঘাতিক মনের জোর! অন্য কেউ হলে ভয়েই আধমরা হয়ে যেত।’’

এই হাসপাতালে মুখে মুখে ফিরছে এমন আশ্চর্য জন্ম-কাহিনি। ভূমিকম্পে ধস্ত গোর্খা জেলার জীবনের সম্বল। গ্রামীণ অঞ্চল শোরপানির শতকরা ৮৫ ভাগই এখন ধ্বংসস্তূপ। সেখানে পাথরের নীচে ঢুকে থাকা আস্ত বাঁ পা-টা নিয়ে কী ভাবে পড়ে ছিলেন আসন্নপ্রসবা? তাঁকে দেখে অনেক চেষ্টা করেও কেউ ধ্বংসস্তূপ সরাতে পারেননি। অসহ্য যন্ত্রণাতেও হার মানেননি পাহাড়ি মেয়ে। বাঁচার জন্য চিৎকার করে ১৭ ঘণ্টা ওই ভাবেই পড়ে থাকেন তিনি। রাত ন’টা নাগাদ শিশুর জন্ম দেন পাথরে বন্দি মা।

তখন পাশে নিজের লোক বলতে বড় ননদ পূজাদিদি।

পরের দিন ভোর পাঁচটায় গাঁয়ের লোকে বহু কষ্টে পাথর সরিয়ে উদ্ধার করে সুনকুমারীকে। রক্তাক্ত দশায় দুর্গত গ্রাম থেকে মুক্ত হয়ে জেলা সদরে এসে পৌঁছতে আরও দু’টো দিন পার হয়েছে। অসুস্থ মেয়েটার পাশে থাকতে নিজের কোলের ছেলেদের গ্রামে রেখে জেলা সদরে চলে এসেছেন ননদ পূজাও।

এখনও দু’পা হেঁটে যেতে চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে ওঠে তরুণী মায়ের। তবু চোয়ালে সেই হার না-মানা ভঙ্গি। হাসপাতালের বেডে বসে দুর্বোধ্য হিন্দি আর নেপালি মিশিয়ে নিজের গল্প বলে চলেন সুনকুমারী।

নার্সদের তর্জমায় স্পষ্ট হয় সে-কাহিনি। ১৪ মাস আগে অর্জুন গুরুঙ্গের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পাহাড়ি গাঁয়ের ক্লাস ফাইভ পাশ মেয়ের। ‘‘বিয়ের পরে আমার শ্রীমানকে (বর) দেখেইছি বার তিনেক। দিদি পূজার বরের সঙ্গে দু’মাস হল মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করতে চলে গিয়েছে ও (অর্জুন)!’’— বলতে থাকেন সুনকুমারী। ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকার সময়ে অসহ্য যন্ত্রণায় বর নয়, নিজের মা-বাপের সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবেই চোখে জল আসছিল মেয়ের। ভূমিকম্পে ধস্ত দেশে এখনও দেখা হয়নি তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু ‘প্রকৃতি’ কোলে আসার পরে এত কষ্টেও নতুন মায়ের মনে যেন এক আকাশ তারা জ্বলজ্বল করছে।

সুনকুমারীর পাশে বসে ননদ পূজা বলেন, ‘‘বাহাদুর লড়কি! পাথরে আটকে থেকে অত কষ্টেও বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দুধ খাইয়েছে। হাসপাতালে আসার আগে আমরা কে-ই বা গাঁয়ে একবেলা ঠিক করে খেতে পেয়েছি! ও (সুনকুমারী) কিন্তু সারা ক্ষণ নিজের বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে বসে।’’ লড়াকু মা-মেয়ের গল্প শুনতে রাজ্যের মেয়ে-বউদের ভিড় জমছে মহিলা ওয়ার্ডে। পোড়খাওয়া সিস্টার সঞ্জনা পারিয়ার সাহসী মায়ের গালে আদর করে বলেন, ‘‘বীর গোর্খালি!’’ হাসপাতালের দেওয়া আনকোরা টুকটুকে হুডওলা পোশাকে সুনকুমারীর মেয়ে সবার কোলে কোলে ঘোরে।

কিন্তু বেটি না হয়ে বেটা হলেই কি ভাল হতো না আপনার? মজা করে প্রশ্নটা করতেই নতুন মায়ের কড়া জবাব, ‘‘গুরুঙ্গদের সমাজে আমাদের বেটা-বেটিতে কোনও ফারাক নেই। কখনও ছিল না!’’

ভূমিকম্পের ধাক্কায় একটা বদল কিন্তু এসেইছে সুনকুমারীর মনে। এত দিন ওষুধ-ডাক্তার-নার্সদের এক ফোঁটা আমল দেননি। এই দুর্যোগে মা হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বুঝেছেন চিকিৎসার মর্ম। মেয়ে বড় হয়ে কী হলে খুশি হবেন? প্রশ্নটা শুনে এক মুহূর্ত ভাবতে হচ্ছে না প্রকৃতির মাকে। মনের জোর ও হাসপাতালের যত্নে নিজের পায়ে খাড়া হওয়া মেয়েটি সোজাসুজি বলছেন, ‘‘আমি চাই নার্স হোক আমার মেয়ে।’’ নার্স সঞ্জনা-সীতাদের ঘরও ভূমিকম্পে ফেটে চৌচির।
তবু তাঁরা অক্লান্ত ভাবে হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন।

ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে বাঁচার ও বাঁচানোর নাছোড় তাগিদটুকুই জীবনের জয়গান হয়ে উঠছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE