অভিযানের পর বিধ্বস্ত লাদেনের গোপন ডেরা।
লাদেন হত্যার প্রতিশোধ নিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র পদস্থ কর্তাকে বিষ খাইয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান! সেই রাতে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন সব মার্কিন কূটনীতিক?
এমনই চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন সাংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট। সিআইএ সূত্রকে উদ্ধৃত করে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে সেই বিখ্যাত অভিযানের রাতে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পাল্টা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা। তাই পাকিস্তানে কর্মরত সব মার্কিন কূটনীতিককে রাতারাতি ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি রাখা হয়েছিল।
২০১১-র ১ মে রাতে উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের গোপন ডেরায় অভিযান চালায় মার্কিন নৌসেনার বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনী ‘সিল টিম-৬’। সেই অভিযানেই মৃত্যু হয় আল কায়েদা প্রধানের। কিন্তু যে মার্কিন গোয়েন্দা ও কূটনীতিকরা এই অভিযানের ছক কষেছিলেন এবং পুরো প্রক্রিয়ার তদারকিতে ছিলেন, পাকিস্তানের মাটিতে তাঁদের দিনগুলো সে সময় খুব একটা সহজ ছিল না।
সিআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে, লাদেনের গোপন আস্তানায় অভিযান চালানোর কিছু দিন আগে থেকে পাকিস্তানে সিআইএ অফিসারদের জন্য পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে উঠছিল। পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসগুলি থেকে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান নিয়ন্ত্রণ করছিল সিআইএ-র যে দল, তার প্রধান ছিলেন জোনাথন ব্যাঙ্ক। তিনি ছিলেন ইসলামাবাদের সিআইএ স্টেশন চিফ। পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই জোনাথন ব্যাঙ্ককে মোটেই পছন্দ করছিল না। সে খবর সিআইএ-র কাছেও ছিল। জোনাথন ব্যাঙ্কের উপর প্রাণঘাতী হামলার তোড়জোড় চলছে বলেও জানতে পেরেছিল ওয়াশিংটন। তাই পাকিস্তানের কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে জোনাথন ব্যাঙ্ককে হঠাৎ সরিয়ে নেওয়া হয় ইসলামাবাদ থেকে।
কেমন ছিল সেই ছক?
তৎকালীন সিআইএ ডেপুটি চিফ মাইকেল মোরেল পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। দিনভর তিনি একাধিক বৈঠকে অংশ নেন পাকিস্তানে। জরুরি বৈঠকগুলি সেরে সে দিনই মোরেলের আমেরিকা ফেরার কথা ছিল। সেই মতো জোনাথন ব্যাঙ্ক এয়ারপোর্টে যান মোরেলকে বিশেষ বিমানে তুলে দিতে। বিমানবন্দরে গিয়ে ব্যাঙ্ক নিজেও সেই বিমানে উঠে পড়েন। বিমান রওনা দেয় আমেরিকার উদ্দেশে। কূটনীতির ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল। পাকিস্তানে নিযুক্ত সিআইএ স্টেশন চিফ পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাবেন এবং পাক কর্তৃপক্ষকে আগে থেকে কিছুই জানতে দেওয়া হবে না, এমনটা হয় না। পাকিস্তান থেকে আমেরিকা ফিরতে হলে নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা মিটিয়েই ফিরতে হবে মার্কিন কূটনীতিক বা গোয়েন্দাদের। অভিবাসনের সেই সব নিয়ম একেবারেই মানা হয়নি জোনাথন ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে। কেউ জানতেন না ব্যাঙ্ক আমেরিকা ফিরছেন। মোরেলকে বিমানে তুলে দেওয়ার জন্য তিনি এয়ারপোর্টে গিয়েছেন বলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানত। কিন্তু মোরেল তাঁকে বিশেষ বিমানে তুলে নিয়ে চলে যাবেন, এমনটা আইএসআই একেবারেই আঁচ করতে পারেনি।
আরও পড়ুন:
সঙ্কট চরমে, ঋণও খারিজ, এফ-১৬ কিনতে পারছে না পাকিস্তান
জোনাথন ব্যাঙ্ককে সরিয়ে নেওয়ার পর সিআইএ তাদের ইসলামাবাদ স্টেশন চিফ হিসেবে পাঠায় মার্ক কেলটনকে। রাশিয়া বিশেষজ্ঞ কেলটন পাকিস্তানে গিয়েও বিখ্যাত ‘মস্কো রুলস’ প্রয়োগ করেন। পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-কে বন্ধু হিসেবে না দেখে শত্রু হিসেবেই দেখতে শুরু করেন কেলটন। পাকিস্তানের জঙ্গি উপদ্রুত এলাকাগুলিতে একের পর এক ড্রোন হানার নির্দেশেও কেলটনই সই করছিলেন তখন। তাঁর উপর আইএসআই এত বিরক্ত ছিল যে তৎকালীন আইএসআই প্রধান আহমেদ সুজা পাশা তাঁর সঙ্গে দেখা করতেও অস্বীকার করেন।
কেলটন ইসলামাবাদে থাকাকালীনই লাদেনের গোপন ডেরায় অভিযান হয়। এই অভিযানের পর যে সিআইএ গোয়েন্দা এবং মার্কিন কূটনীতিকদের উপর আইএসআই হামলা চালাতে পারে, সে আশঙ্কা ওয়াশিংটনের ছিলই। তাই বিপদের আঁচ পেলেই দ্রুত ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়ার জন্য সব কূটনীতিক এবং গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছিল। করাচির উপকূলে অপেক্ষমান মার্কিন রণতরীও কূটনীতিক এবং গোয়েন্দাদের উদ্ধার করতে প্রস্তুত ছিল।
২০১১ সালের ১ মে রাতে যখন লাদেনের ডেরায় পৌঁছে গিয়েছিল মার্কিন নৌসেনার সিল টিম-৬, তার আগে থেকেই অ্যাবটাবাদের আকাশে সন্তর্পনে চক্কর দিচ্ছিল মার্কিন ড্রোন। ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের গোপনতম চেম্বারে বসে সেই ড্রোনের পাঠানো ছবি দেখছিলেন কেলটন ও অন্য দুই সিআইএ কর্তা। লক্ষ্য রাখছিলেন প্রতি মুহূর্তের গতিবিধির উপর। প্রয়োজন হলে দূতাবাস ছেড়ে করাচির পথে বা ভারতের পথে দ্রুত রওনা দেওয়ার প্রস্তুতিও অবশ্য তাঁরা নিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও বিপদ দেখতে পাননি কেলটনরা। আইএসআই যে আরও সন্তর্পনে কেলটনকে নিকেশ করার ছক কষেছে, তা বুঝতে পারেননি মার্কিন গোয়েন্দারা।
কী করেছিল আইএসআই? মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, কেলটনের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল আইএসআই-এর চর। লাদেন-নিকেশ অভিযান শেষ হতেই অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন মার্ক কেলটন। তাঁর পেটে প্রবল ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথ্যা এত বাড়ে যে তাঁর অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। পাকিস্তানে কেলটনের চিকিৎসা করানোর ঝুঁকি আর নেয়নি আমেরিকা। ফের পাক কর্তৃপক্ষকে কিছুই না জানিয়ে কেলটনকে বিশেষ বিমানে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তলপেটে অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy