এই অবস্থাতেই এভারেস্টেই পথে পাওয়া গিয়েছিল জমে যাওয়া জর্জ ম্যালরির মৃতদেহ। ফাইল চিত্র।
উষ্ণায়নের প্রভাবে গলছে হিমালয়ের বরফ, গলছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের বিভিন্ন হিমবাহ-ও। আর সেই বরফ গলতেই বেরিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা একের পর এক পর্বতারোহীর মৃতদেহ। গত একশো বছর ধরে হিমালয়ের তুষারে সমাধিস্থ পর্বতারোহীদের মৃতদেহ বেরিয়ে আসায় সমস্যায় পড়েছেন নেপালের পর্বতারোহী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। মৃতদেহ বেরিয়ে এলে তা নামিয়ে নিয়ে আসা উচিত কিনা, তা নিয়েও শুরু হয়েছে নয়া বিতর্ক।
১৯২২ সাল থেকে ধরলে এখনও পর্যন্ত প্রায় চার হাজার আটশো পর্বতারোহী জয় করেছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। কিন্তু তাঁদের অনেকেই শৃঙ্গ জয় করার পর আর নিরাপদে ফিরে আসতে পারেননি । ফেরার পথেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন এভারেস্টের বুকেই। অনেকেই আবার শৃঙ্গ জয় করতে যাওয়ার পথেই প্রাণ হারিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রায় তিনশো জন পর্বতারোহী এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। আর তাঁদের দুই তৃতীয়াংশই সমাধিস্থ আছেন এভারেস্টেই। বরফের তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায়নি এত দিন।
কিন্তু উষ্ণায়ণ বদলে দিয়েছে এত দিনের এই চিত্র। গত কয়েক বছর ধরে সারা পৃথিবীর সঙ্গে বাড়ছে হিমালয়ের তাপমাত্রাও। আরও বেশি করে গলছে এভারেস্টের বিভিন্ন হিমবাহ। তার ফলেই এত দিন ধরে বরফে চাপা পড়ে থাকা পর্বতারোহীদের মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে অনেক বেশি সংখ্যায়। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি আং শেরিং শেরপা। তাঁর কথায়, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়নের জন্য দ্রুত গতিতে গলছে হিমালয়ের বরফ আর হিমবাহ। সেই কারণেই বেরিয়ে আসছে একের পর এক মৃতদেহ। এভারেস্টে ওঠার পথে বিভিন্ন জায়গায় তা দেখতেও পাচ্ছেন পর্বতারোহীরা। ২০০৮ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা আট জন পর্বতারোহীর মৃতদেহ উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে এনেছি। তার মধ্যে কোনও কোনও মৃতদেহ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বরফের তলায় চাপা পড়ে ছিল।’’
খুম্বু হিমবাহের এই অংশেই মিলছে সব থেকে বেশি মৃতদেহ। ছবি: সংগৃহীত।
আরও পড়ুন: মোজ়াম্বিকে ঝড়, মৃত বেড়ে ৬০০
নেপাল ন্যাশনাল মাউন্টেন গাইড অ্যাসোসিয়শনের তরফে সবিত কুঁয়ার জানাচ্ছেন, ‘‘বিষয়টি উদ্বেগজনক। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা আমাদের। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা সবাইকে জানাচ্ছি, যাতে কিছু একটা করা সম্ভব হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমরা মৃতদেহ নামিয়ে আনছি। কখনও আবার শুধুই প্রার্থনা করে পাথর আর বরফ দিয়ে মৃতদেহগুলি চাপা দিয়ে দিচ্ছি।’’
এভারেস্টে ওঠার পথে সব থেকে বিপজ্জনক জায়গা হল খুম্ভু হিমবাহ। একশো বছর ধরে এই হিমবাহের আশপাশেই মারা গিয়েছেন সব থেকে বেশি পর্বতারোহী। আর এই অংশেই বরফ গলে বেরিয়ে আসছে সব থেকে বেশি মৃতদেহ— গত কয়েক বছরে এমনটাই অভিজ্ঞতা পর্বতারোহীদের।
মাউন্ট এভারেস্টের উপরের দিকে ক্যাম্পগুলি অত্যন্ত দুর্গম। উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও অত্যন্ত কম। সেই উচ্চতা থেকে মৃতদেহ নামিয়ে আনা অনেক সময়ই বিপজ্জনক এবং সময়সাপেক্ষ। এই ধরনের অভিযানের খরচও অত্যন্ত বেশি। পাশাপাশি আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেও তাঁরা অনেক সময় কিছু করতে পারেন না বলে জানাচ্ছেন পর্বতারোহীরা। নেপাল সরকারের তরফে এই বিষয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় আরও বাড়ছে এই সমস্যা। পর্বতারোহণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মত, নেপাল সরকার এবং বিভিন্ন পর্বতারোহণ সংস্থা এক যোগে কিছু করলে তবেই বরফ গলে বেরিয়ে আসা পর্বতারোহীদের সুষ্ঠু ভাবে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে দুই বোনকে অপহরণ করে ধর্মান্তর! জোর করে বিয়ে দেওয়ার অভিযোগ
নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি আং শেরিং-এর বক্তব্য, ‘‘কিছু দিন আগেই একটি মৃতদেহ বেরিয়ে এসেছিল পর্বতশৃঙ্গের প্রায় কাছে, ৮,৭০০ মিটার উচ্চতায়। মৃতদেহটি ঠান্ডায় জমাট বেঁধে গিয়েছিল। মৃতদেহটির ওজন হয়ে গিয়েছিল প্রায় ১৫০ কেজি। আর তা বেরিয়ে এসেছিল অত্যন্ত দুর্গম একটি জায়গায়। ওই জায়গাটি থেকে মৃতদেহ নিচে নামিয়ে আনতে বেশ কষ্টই হয়েছিল আমাদের।’’
পর্বতারোহণের যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই অবশ্য মৃতদেহ নামিয়ে আনা নিয়ে সহমত নন। অনেক পর্বতারোহীই মৃত্যু হলে হিমালয়ের বুকে সমাধিস্থ থাকাই নিজের পছন্দের বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়। পর্বতের প্রতি ভালবাসা থেকেই এই রকম ইচ্ছে তাঁদের। সে ক্ষেত্রে কোনও পর্বতারোহীকে নামিয়ে আনা তাঁদের জন্য অসম্মানজনক, এমন মত অনেকেরই। তাই মৃতদেহ বেরিয়ে এলে তা নামিয়ে আনা উচিত কিনা, তা নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy