Advertisement
১৬ মে ২০২৪
আতঙ্কের দেশে আনন্দবাজার

সাবধানি শহরে প্রায়ই চলছে ‘হলচল’

শান্ত জনপদের চেহারাটা পাল্টে গেল এক মুহূর্তে। বুধবার, দুপুর। ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত গোর্খা থেকে মুগলিংয়ের পথে আবু খৈরানির চিলতে খাজাঘরে (লাইন হোটেল) ঢুকেছি তখন। আশপাশে প্রায় ডাকাত-পড়া উত্তেজনা! কী হয়েছে জানতে চাইতে ক্যাশ কাউন্টারে ব্যস্ত হোটেল মালিক রাজকুমার শ্রেষ্ঠ স্মিত মুখে বললেন, ‘‘ফির থোড়া ‘হলচল’ শুরু হুয়া।’’

আহতকে শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের পথে স্বেচ্ছাসেবক। বুধবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

আহতকে শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের পথে স্বেচ্ছাসেবক। বুধবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

ঋজু বসু
মুগলিং ( নেপাল) শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩১
Share: Save:

শান্ত জনপদের চেহারাটা পাল্টে গেল এক মুহূর্তে। বুধবার, দুপুর। ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত গোর্খা থেকে মুগলিংয়ের পথে আবু খৈরানির চিলতে খাজাঘরে (লাইন হোটেল) ঢুকেছি তখন।
আশপাশে প্রায় ডাকাত-পড়া উত্তেজনা! কী হয়েছে জানতে চাইতে ক্যাশ কাউন্টারে ব্যস্ত হোটেল মালিক রাজকুমার শ্রেষ্ঠ স্মিত মুখে বললেন, ‘‘ফির থোড়া ‘হলচল’ শুরু হুয়া।’’
যতই ‘থোড়া’ হোক, যতই নির্বিকার থাকুন রাজকুমার, আশপাশের টেবিলগুলো তত ক্ষণে প্রায় ফাঁকা। ‘হলচল’-এর সময়টা অবশ্য সেকেন্ডখানেকের বেশি নয়! সত্যি বলতে কী, মাটির একটু নীচে (শহরে যাকে বেসমেন্ট বলে) দোকানঘরে বসে কোনও আন্দোলনই টের পাইনি। কিন্তু আশপাশের উত্তেজনার আবহে স্থির থাকা গেল না। ঝটপট সিঁড়ি ভেঙে ফুটপাথে উঠেই দেখি, ঝিমিয়ে থাকা গঞ্জশহর প্রায় গোটাই পথে নেমে এসেছে।

এই কাঁপুনিকে রাজকুমার আমল না-দিলেও বাহারি ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির অপরিচিত স্থানীয় যুবক বকুনির সুরে বললেন, এখন হোটেলে ঢোকার নামগন্ধ করবেন না। রাজকুমারের বউদি গঙ্গা শ্রেষ্ঠ পাশের মুদি-দোকান থেকে এসে হোটেলের সিঁড়িতে ঝুঁকে রাজকুমারকেও তক্ষুণি বেরিয়ে আসার জন্য বকাঝকা জুড়ে দিলেন।

কিন্তু ওই একটি মুহূর্ত মাত্র! তার পরে আর কিছু টের না-পেলেও গোটা মহল্লাই ‘অ্যাটেনশন’ ভঙ্গিমায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল রাস্তা জুড়ে। মিনিট কুড়ি পর পাশের গঞ্জ শহর মুগলিংয়ে এসে পৌঁছেও দেখি, সেই হলচল নিয়েই চর্চা চলছে।

মুগলিংয়ের হোটেলে ঘাঁটি গাড়া দিল্লির একটি টিভি চ্যানেলের গাড়ির ড্রাইভার প্রদীপ বামান কিছুতেই দোতলায় উঠবেন না বলে ধনুক-ভাঙা পণ করলেন। সংবাদমাধ্যম দলের অন্য সদস্যরা এ দিন পাহাড়ি পথে অভিজ্ঞ অন্য একটি গাড়ি ধরে ‘খবর’ করতে বেরিয়েছেন। প্রদীপ দুপুরে হোটেলেই বিশ্রাম করছিলেন। হঠাৎ খাটের তলায় ‘ভাইব্রেশন’ টের পেয়ে সেই যে ঘর ছেড়েছেন আর উপরে ওঠার নামগন্ধ করলেন না। মালপত্র গুছিয়ে হোটেলের রোয়াকে বসে ফোন করে সঙ্গী সাংবাদিকদের জানালেন, কেউ তাঁর সঙ্গে না গেলেও, রাতেই দিল্লিমুখো হবেন তিনি।

নাগাড়ে মৃদু কম্পনের সঙ্গে সহবাস অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে নেপালবাসীর। তবু প্রতিটা কাঁপুনিই বিভীষিকার স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। এ দিনই গোর্খার হেলিপ্যাডে সদ্য উদ্ধার সিমজিম পাতলে গ্রামের যুবক, পেশায় কলকাতার বড়বাজারের ত্রিপলপট্টির কুলি লেখবাহাদুর গুরুঙ্গ বলছিলেন, আজ সকালেও নাকি ঘরের ধ্বংসস্তূপে ভাল ঝটকা টের পেয়েছেন। গোর্খা জেলার প্রান্তে ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি অঞ্চলে তো বটেই, খাস জেলা সদর হাসপাতালের ডাক্তার কৃষ্ণ ঢাকালও বললেন, রাতে দু-দু’বার হাল্কা ঝাঁকুনির কথা।

রাতারাতি দেশের অন্যতম ব্যস্ত চিকিৎসাকেন্দ্র হয়ে ওঠা গোর্খা জেলা হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগটি কয়েক মাস আগেই সারাই করা হয়েছে। ডাক্তারবাবুদের দাবি, ওই অংশটি নাকি ভূমিকম্প রোখার জন্য পোক্ত। তবে হাসপাতালের পুরনো ভবনে রয়েছেন অনেক রোগী। একেবারে ঠাঁই না-পেয়ে খোলা আকাশের নীচে ছাউনি করে যে রোগীদের গতি হল, আতঙ্কের আবহে তাঁদেরকেই ভাগ্যবান ঠাহর করছেন কেউ কেউ।

গোর্খা সদরের কাছে বারো কিলো মোড়ে প্রত্যন্ত বারপাকের দিকের রাস্তায় কিছু দূর এগিয়েও একই আতঙ্কের কাহিনি কানে আসছে। একেবারে পাহাড়ের কিনারে ভূমিকম্পে চিড় ধরা চিলতে কাঠের ঘরে ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন অনিতা শ্রেষ্ঠা। খোপলান বিমিরে গ্রামের তরুণীও বিক্ষিপ্ত ঝটকা টের পাচ্ছেন মাঝে মাঝেই। শহুরে বহুতলে ভূমিকম্পের বিপদের থেকে এই তল্লাটে বিপদের মাত্রা কিন্তু অন্য। এই বুঝি ঝটকার চোটে উপরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ল, ভাবতে ভাবতে সারা দিন অস্থির হচ্ছেন অনিতারা। রাতে তবু খানিক স্বস্তি। পাহাড়ের একটু উপরে একচিলতে খোলা উপত্যকায় দল বেঁধে ঘুমোচ্ছে গোটা গ্রাম।

চিতওয়ান জেলার সরগরম বাজার এলাকা মুগলিং এ দিন সকালেই ঝটকার হাত থেকে অবশেষে মুক্তি মিলেছে ভেবে খানিক গুছিয়ে নিয়েছিল। দুপুরের মৃদু ঝটকাই ফের পাল্টে দিল আবহ। হোটেল মালকিন সোনু গুরুঙ্গ অবশ্য রাত পর্যন্ত ‘কিচ্ছু হবে না, ঘরেই ঘুমোন’ বলে অতি‌থিদের ভরসা দিয়ে চলে গেলেন। রাতে দেখা গেল, নিজের কোলের মেয়েটিকে হোটেলের চৌকাঠেই কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন।

বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের অনেকের অল্প-বিস্তর মাথাও ঘুরছে। বহিরাগত অতিথিরা সারা ক্ষণ মালপত্র গুছিয়ে পকেটে টাকার ব্যাগ, পাসপোর্ট নিয়ে তৈরি। কিছু হলেই তক্ষুণি পথে নামবেন।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আফটার শক চলবে মাসখানেক। তার মানেই যে বড় বিপর্যয় এখনই ফিরবে, তা বলা যায় না। গোর্খার হেলিপ্যাডে দুর্গতদের চিকিৎসার কাজে সামিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ব্রিটিশ চিকিৎসক ইয়ান ফেরের মনে করালেন, ভূকম্পজনিত আতঙ্ক বা সিসমোফোবিয়ার কথাও। ‘‘এত বড় দুর্যোগের পরে ফের ভূমিকম্প হওয়ার আতঙ্কটাও স্বাভাবিক। দুর্গতদের মনের ক্ষত সারিয়ে তোলাটাও কম জরুরি নয়।’’ মৃত্যুমিছিল, উদ্ধারকাজ আর চিকিৎসায় জেরবার দেশে মনের কথা ভাবাটাই অবশ্য বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে।

তবে এ সব জল্পনায় ফাঁকা জলের বোতল হাওয়ায় নড়তে দেখলেও বুকটা একটু ছ্যাঁত করে উঠছে বৈ কী! কম্পনে বেসামাল দেশে কোনটা বনের বাঘ আর কোনটা মনের— তা-ই বা কে জরিপ করবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE