গ্রাফিক। শৌভিক দেবনাথ।
ঠিক এক বছর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে অভিযোগ তোলা হয়েছিল ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত দু’সপ্তাহে তালিবান অগ্রগতি সেই অভিযোগকেই আরও জোরাল করে তুলেছে। উত্তর আফগানিস্তানের বদখশান থেকে দক্ষিণের কন্দহর পর্যন্ত একের পর এক প্রদেশে তালিবানের জয়ের পিছনে পাকিস্তানের ‘ভূমিকা’ দেখছেন সামরিক বিশ্লেষকেরা। কাবুলের সরকারও একই অভিযোগ তুলছে।
চলতি সপ্তাহেই আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি সরাসরি তালিবানকে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে। শুক্রবার আফগানিস্তানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহ দাবি করেছেন, কন্দহর প্রদেশের স্পিন বলডাক জেলায় তালিবান যোদ্ধাদের মদত দিয়েছে পাক বিমানবাহিনী। পাকিস্তানের বালুচিস্তান লাগোয়া ওই এলাকা বৃহস্পতিবার দখল করছে তালিবান। সেখানেই সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে নিহত হয়েছেন রয়টার্সের ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। সালেহর কথায়, ‘‘তালিবান বাহিনীকে ঠেকাতে আফগান বায়ুসেনা তৎপর হয়েছিল। কিন্তু পাক বিমানবাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হয় আফগান বায়ুসেনাকে।’’
পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অবশ্য তালিবানকে মদত দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘‘গত দেড় দশকে প্রায় ৭০ হাজার পাক নাগরিক হিংসার বলি হয়েছেন। আমরা আর রক্তপাত চাই না।’’ যদিও পাক সংবাদমাধ্যমের একাংশও সে দেশের সেনা এবং গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর তালিবান যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলেছে ইতিমধ্যেই। সেই সূত্রেই ফের সামনে এসেছে গত বছর জুলাইয়ে প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই নিরাপত্তা বিষয়ক রিপোর্টের প্রসঙ্গ। তাতে বলা হয়েছিল, পাক মদতে পুষ্ট প্রায় সাড়ে ছ’হাজার জঙ্গি সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকেছে আফগানিস্তানে। ঘাঁটি গেড়েছে কন্দহর, হেলমন্দ, নিমরুজ-সহ অন্তত ১২টি প্রদেশে। তালিবানের পাশাপাশি, আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলছে তারা।
পাকিস্তানের হক্কানি জঙ্গিগোষ্ঠী আফগান তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার মূল দায়িত্বে রয়েছে বলেও বলা হয়েছিল ওই রিপোর্টে। খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সক্রিয় হক্কানি গোষ্ঠী অতীতে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস-সহ একাধিক নাশকতায় জড়িত। পাক সেনা এবং আইএসআই-এর সঙ্গে এই গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। অন্য দিকে, দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সক্রিয় ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) গত দু’দশকে একাধিক হামলা চালিয়েছে পাক সেনার উপর। ইসলামাবাদের অভিযোগ, টিটিপি-কে মদত দেয় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’।
আফগান তালিবানের বর্তমান দুই শীর্ষনেতা হিবাতুল্লা আখুনজাদা এবং মৌলানা বারদার দু’জনের সঙ্গেই পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ২০১০ সালে ন্যাটো বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর প্রায় ৯ বছর পাকিস্তানের জেলে ছিলেন বারদার। আইএসআই-এর ‘তৎপরতা’তেই তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি, হিবাতুল্লার সম্মতিতে কয়েকজন তালিবান নেতা কাতারে ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোপন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন বলে পাক সংবাদমাধ্যমের একাংশের দাবি।
তবে শুধু পাক মদত নয়। তালিবানের সাম্প্রতিক চমকপ্রদ পুনরুত্থানের পিছনে আফগান জনতার একটি বড় অংশের সহযোগিতা রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্বে গৃহযুদ্ধের সময়ও সে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল তালিবান। কিন্তু ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান লাগোয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিরোধী জোট ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’-এর দখলে ছিল। মধ্য এবং দক্ষিণ আফগানিস্তানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী পাশতুনদের প্রাধান্য থাকলেও উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের ওই এলাকাগুলিতে হাজারা, তাজিক, উজবেক জনগোষ্ঠীর বাস। প্রথাগত ভাবেই তারা পাশতুন জনগোষ্ঠী পরিচালিত তালিবানের বিরোধী। এ বার গৃহযুদ্ধের সূচনাতেই ইরান সীমান্তে ইসলাম কালা ও তুর্কমেনিস্তান সীমান্ত-ঘেঁষা টোরঘুন্ডির দখল নিয়েছে তালিবান। তাজিকিস্তান সীমান্তের বেশ কিছু এলাকাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। এই পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার শেষ হলে আশরফ সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে প্রবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy