উৎকণ্ঠার প্রহর। এন্টালির বাড়িতে জুডিথ ডিসুজার দিদি অ্যাগনেস এবং বাবা ডেনজিল। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
ছোটবেলায় শিয়ালদহের লরেটো স্কুলে পড়ার সময়ে সিস্টার সিরিলের সংস্পর্শে আসা। সেই সান্নিধ্যই সমাজসেবার নেশাকে মনের মধ্যে পাকাপোক্ত জায়গা করে দিয়েছিল।
যার টানে শেষমেশ হিংসাদীর্ণ আফগান-ভূমিতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার মেয়ে জুডিথ ডিসুজা। ঝুঁকির পরোয়া না-করে উনচল্লিশ বছরের সাহসিনী কাবুলে বসে মহিলা-শিশুদের অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে কাজ করছিলেন। সেখানেই অপহৃত হয়েছেন। কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন এখনও দায় স্বীকার না-করলেও সন্দেহের তির তালিবানের দিকে।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় এন্টালির সিআইটি রোডে জুডিথের বাড়িতে ফোন আসে কাবুলের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে। ফোন ধরেন জুডিথের দিদি অ্যাগনেস। ও প্রান্তে ছিলেন আফগানিস্তানের ভারতীয় হাইকমিশনার মনপ্রীত ভোরা স্বয়ং। খবরটা তিনিই পরিবারকে দেন। অ্যাগনেস আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী করে হল? কারা ওকে তুলে নিয়ে গেল? মনপ্রীত শুধু বলেন, ‘‘যতটুকু জানানো গেল, তার বেশি তথ্য আমাদের কাছেও নেই। আরও খবর জোগাড়ের চেষ্টা করছি। পেলেই জানাব।’’
সেই থেকে শুরু হয়েছে উৎকণ্ঠার প্রহর গোনা। শুক্রবার রাত পর্যন্ত আর কোনও খবর আসেনি। জুডিথের মোবাইলও বন্ধ। ‘‘কাবুলে ফোন করছি। কোথাও যোগাযোগ হচ্ছে না। শুক্রবার ওখানে সব ছুটি।’’— আক্ষেপ করছেন দিদি। তিনি জানান, যে সংগঠনের হয়ে জুডিথ কাজ করছিলেন, সেই আগা খান ফাউন্ডেশনের তরফে এ দিন বিকেল পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে তাঁরা ফাউন্ডেশনে ই-মেল পাঠিয়েছেন।
জুডিথরা তিন ভাই-বোন। জুডিথ সকলের ছোট। দাদা-দিদির মতো তিনিও বিয়ে করেননি। বাবা ডেনজিল কলকাতার আদি বাসিন্দা, বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। জুডিথ স্কুল পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। তত দিনে আর্ত-নিপীড়িতকে সেবার তাগিদ মনে শিকড় গেড়ে বসেছে। তাই সমাজসেবার পাঠ নিতে চলে যান মুম্বইয়ে, নির্মলা নিকেতন স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ক-এ। বাবার শরীর খারাপ হওয়ায় আবার কলকাতায় ফেরা। এখানে যুক্ত হন চার্চ ইয়ুথ গ্রুপ নামে এক সংগঠনের সঙ্গে।
সেই ইস্তক নিজের লক্ষ্য নিয়ে টানা কাজ। অ্যাগনেস জানান, তাঁর বোন গত দশ বছর ধরে সমাজসেবায় মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। বেশ ক’বছর হল, জুডিথ আগা খান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত। সেই সূত্রে প্রথমে দিল্লি, সেখান থেকে ইতালি-ফ্রান্স ঘুরে ২০১৫-র জুলাইয়ে তাঁর কর্মক্ষেত্র হয় কাবুল।
ডেনজিল জানান, সপ্তাহে অন্তত চার-পাঁচ দিন মেয়ের সঙ্গে তাঁদের কথা হতো। গত বুধবারও হয়েছে। ‘‘বছরখানেক কাবুলে রয়েছে, কিন্তু এক বারও বলেনি, ভয় করছে। কাজে কোনও অসুবিধে বা বাধার কথাও বলেনি। আমরাই বরং ভয়ে মরতাম,’’ বলেন অ্যাগনেস। দিদির কথায়, ‘‘মাঝে-মধ্যে সুযোগ পেলেই কলকাতা ঘুরে যেত। এই তো, মার্চ মাসে এসে ক’দিন কাটিয়ে গেল। আবার এ মাসের ১৫ তারিখে আসার প্ল্যান ছিল।’’
জুডিথের দাদা জেরম থাকেন বেঙ্গালুরুতে। আজ, শনিবার তিনি কলকাতায় আসছেন। অ্যাগনেস বলেন, দিল্লিতে তাঁদের বন্ধু-বান্ধবেরা বিদেশ মন্ত্রকে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দিদির একটাই প্রার্থনা, ‘‘আমার বোনকে সুস্থ, অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার
ব্যবস্থা করুক ভারত সরকার। এর বেশি কিচ্ছু চাই না।’’
অপহরণের খবর চাউর হয়ে যাওয়ায় দুপুর থেকে ডিসুজাদের ফ্ল্যাটে সংবাদমাধ্যমের ভিড়। জুডিথের মা গ্লোরিয়া কথা বলার অবস্থায় নেই। এন্টালির লরেটো স্কুলের শিক্ষিকা অ্যাগনেসের পায়ে সমস্যা, ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হয়। মূলত তিনিই সব সামলাচ্ছেন। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন। আর কথাবার্তার ফাঁকে তাঁর মোবাইলটি বেজে চলেছে একটানা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সকলে খোঁজ নিচ্ছে।
চেনা মেয়েটির এ হেন খবর শুনে পরিচিতেরা বাক্যহারা। ভিড় দেখে চলে এসেছিলেন পাশের ফ্ল্যাটের অদিতি আমরে। বললেন, ‘‘বাইশ বছর আগে বিয়ে করে যখন এ বাড়িতে এলাম, জুডিথ তখন স্কুলে পড়ে। সেই থেকে দেখছি। ওকে তুলে নিয়ে গেল! নিজেকেই বিপন্ন মনে হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy