ইতিহাসের পথ বদল। তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সন্দেহের মেঘ কেটে যেতেই দীর্ঘ এক দশক পরে ইরানের উপর থেকে যাবতীয় অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের অপেক্ষায় এখন গোটা বিশ্ব। রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা কেটে যেতেই তেহরান জানিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে রোজ ৫ লক্ষ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল গোটা বিশ্বে পাঠাতে চলেছে তারা। আর নাটকীয় ভাবে ইরান ও আমেরিকার জেলে বন্দিদের মুক্তির পর্বও শুরু হয়ে গিয়েছে।
তেহরান সরকার গোপনে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে, এই সন্দেহ থেকেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি তাদের উপর প্রবল চাপসৃষ্টি করেছিল। পরমাণু কর্মসূচির উপর নজরদারি করে থাকে যে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সেই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি তেহরানকে যাবতীয় পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসার জন্য বললেও এক দশক আগে এতে সহযোগিতার মনোভাব দেখায়নি ইরান। ফলে বাণিজ্য ও তেল রফতানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে ইরানকে একঘরে করে দিয়েছিল আমেরিকা সহ বিশ্বের
প্রধান শক্তিশালী দেশগুলি। কিন্তু গত কয়েক দিনে এই বিষয়ে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তার পরেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তবে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়ার পরেও রবিবার আবার নতুন করে ইরানের ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র কর্মসূচির উপর নিযেধাজ্ঞা জারি করেছে ওবামা প্রশাসন।
ভিয়েনায় মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি জানিয়েছেন, গত দু’বছর ধরে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের দেওয়া যাবতীয় আশ্বাস অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে তেহরান। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরমাণু নজরদারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি ইরানকে এই সার্টিফিকেট দিচ্ছে। সে জন্যই তেহরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেল ও অন্য বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে অবরোধ তো তুলেই নিয়েছে, পাশাপাশি ইরানের সংস্থাগুলির ১০০০০ কোটি ডলারের সম্পত্তির উপর চাপিয়ে রাখা আর্থিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই সংক্রান্ত কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ইতিমধ্যে সইও করে দিয়েছেন।
গোটা ঘটনায় তেহরানে এখন তুমুল উচ্ছ্বাস ও স্বস্তির আবহাওয়া। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রৌহানির ব্যাখ্যা, ‘‘সন্দেহ, ষড়যন্ত্র বা শত্রুতার ভাবনাকে দূরে ঠেলে আমরা বিশ্বের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ইরান আর বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে।’’ রৌহানির মতে, ‘‘ইরান কারও শত্রু নয়। এই সিদ্ধান্তে আমাদের বন্ধুরা খুশি, প্রতিযোগীদেরও ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।’’ আর এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মন্তব্য, ‘‘ইরানকে পরমাণু বোমার রাস্তা থেকে সরিয়ে এনেই এই সিদ্ধান্ত। যুদ্ধ নয়, কূটনীতির পথেই ঘটলো এই ঐতিহাসিক ঘটনা।’’
তবে গোটা ঘটনা নাটকীয় মোড় নিয়েছে ইরান ও আমেরিকা—দু’দেশই নিজেদের জেলে বন্দিদের মুক্তি দিতে শুরু করায়। তেহরান সে দেশে বন্দি পাঁচ মার্কিনকে মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জ্যাসন রেজাইয়ান। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ইরান থেকে চলে এসেছেন বলেও জানিয়েছে ওয়াশিংটন
পোস্ট। পাশাপাশি ওয়াশিংটনও সে দেশে দোষী সাব্যস্ত সাত জন বন্দি ইরানির মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত মকুব করেছে। ইরানের চোদ্দো জনের
উপর থেকে ইন্টারপোলে পাঠানো নোটিসও প্রত্যাহার করে নিয়েছে ওয়াশিংটন।
ইরানের উপর থেকে অবরোধ তোলার সিদ্ধান্ত গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে কী ভাবে, কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে জল্পনা ও হিসেবনিকেশ শুরু হয়েছে। তবে তেহরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন যিনি, জর্জ বুশ প্রশাসনের সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর নিকোলাস বার্নের মতে, তেহরানের অবরোধ তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচকরা হয়তো অনেক কথা বলবেন। কিন্তু ঘটনা হল, আগামী ১০-১৫ বছর পরমাণু শক্তি নিয়ে ইরানের যারতীয় আকাঙ্খায় তালা পড়ে গিয়েছে।
ওবামা প্রশাসন সূত্রের খবর, পরমাণু প্রশ্নটির পাশাপাশি তেহরানের সঙ্গে বন্দি মুক্তি নিয়ে পৃথক ভাবে আলোচনা চলছিল। জন কেরি ও মার্কিন দেশে শিক্ষিত ইরানের মন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফের আলোচনার মধ্য দিয়েই এই প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy