কিউজেড-৮৫০১ বিমানের উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র। ছবি: এপি।
সত্যি হল আশঙ্কাই।
এয়ার এশিয়ার বিমান কিউজেড-৮৫০১ নিখোঁজ হওয়ার তিন দিনের মাথায় জাভা সাগরে ভেসে উঠল মৃতদেহ ও ধ্বংসাবশেষ। সেগুলি যে উধাও হয়ে যাওয়া বিমানেরই অংশ, মঙ্গলবার রাতে সে কথা সরকারি ভাবে জানিয়ে দিল ইন্দোনেশিয়া প্রশাসন।
জাভা সাগরে এ দিন সকাল ছ’টা থেকে শুরু হয়েছিল তল্লাশি। বেলা ১২টা ৫০-এ ইন্দোনেশিয়ার বায়ুসেনার একটি বিমান প্রথম লক্ষ করে, জলের মধ্যে বড়সড় ছায়া দেখা পড়ছে কিছুর। তার পরেই শোনা যায়, জলে ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেহ ভাসতে দেখেছে নৌ-সেনার জাহাজ। ইন্দোনেশিয়ার নৌ বাহিনী সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত ৪০টি দেহ উদ্ধার করেছে তারা।
রবিবার ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে ১৬২ জন সওয়ারি নিয়ে মাঝ আকাশে উধাও হয়ে যায় এয়ার এশিয়ার বিমান কিউজেড-৮৫০১। আজ রাজধানী জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার পরিবহণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত ডিজি জোকো মুরজাতমোদজো বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার খবর জানান সাংবাদিকদের।
রেডারে শেষ বার যেখানে এয়ারবাস ৩২০-২০০-কে দেখা গিয়েছিল, তার ৬৬ মাইলের মধ্যেই মঙ্গলবার মিলল বিমানের কাঠামোর কিছু অংশ। তল্লাশি অভিযানের মূল দায়িত্ব রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ এজেন্সির উপর। তাদের প্রধান বামবাং সোয়েলিস্টিও এ দিন জানিয়েছেন, উজ্জ্বল লাল-কালো ও সাদা রঙের অনেক জিনিস ভাসতে দেখা গিয়েছিল বোর্নিওর সেন্ট্রাল কালিমানটন প্রদেশের পাঙ্গকালান বান-এর প্রায় ১০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। পরে ডুবুরি নামিয়ে দেখা যায় সেগুলি আসলে যাত্রীদের সুটকেস, লাইফ জ্যাকেট ও বিমানের দরজা।
সোয়েলিস্টিওর সাংবাদিক বৈঠক আজ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় টিভি-চ্যানেলে। উদ্ধারকাজের ভিডিও যখন দেখানো হচ্ছে, ক্যামেরায় ধরা পড়ে জলে পচে যাওয়া বিকৃত লাশের ছবি। তবে উদ্ধার হওয়া দেহগুলিতে কোনও লাইফ-জ্যাকেট ছিল না। নৌসেনা ৪০টি ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেহ উদ্ধারের কথা জানালেও সরকারি ভাবে অবশ্য এ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি।
অলৌকিক কিছু হবে, এই আশাটুকু আঁকড়েই তিন দিন ঠায় বিমানবন্দরে বসে ছিলেন নিখোঁজ যাত্রীদের আত্মীয়রা। টিভির পর্দায় আটকে ছিল চোখ। সোয়েলিস্টিওর সাংবাদিক বৈঠকে প্রিয়জনের চেনা চেহারার ওই বীভৎস ছবি দেখে আর বাঁধ মানেনি তাঁদের আবেগ। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠার প্রহর মুহূর্তে বদলে গেল হাহাকারে। ভয়ঙ্কর এই পরিণতি হয়তো আঁচ করেছিলেন, কিন্তু খবরটা যখন সত্যিই এল তা মেনে নিতে পারলেন না অনেকেই। সুরাবায়া বিমানবন্দরের ক্রাইসিস সেন্টারের মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন দু’জন। শোকে স্তব্ধ এয়ার এশিয়ার সিইও টনি ফার্নান্ডেজও। টুইটারে তিনি লিখেছেন, “মনের অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। যাত্রীদের পরিবারের পাশে আছি।”
উদ্ধার হওয়া দেহ ও বিমানের কাঠামোর অংশ হেলিকপ্টারে করে তুলে আনা হচ্ছে বেলিটাং দ্বীপে। বিকৃত দেহ রাখার জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছে সেখানকার হাসপাতালগুলিকে। শোনা যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো যাবেন বেলিটাং দ্বীপে। মৃতদের আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করারও কথা আছে তাঁর।
উধাও বিমানের ধ্বংসাবশেষ মেলার পরই ওই এলাকায় আরও জোরদার করা হয়েছে তল্লাশি। ক্ষীণ শব্দ তরঙ্গ ধরা পড়বে, এমন উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ ইতিমধ্যেই রওনা দিয়েছে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে। নামানো হয়েছে ডুবুরিও। জাভা সাগরের প্রায় ১৫৬০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ১৩টি সেক্টরে ভাগ করে এ দিন নজরদারি চালায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়ার বিমান ও জাহাজ। এত দিন এয়ারবাস ৩২০-২০০-র খোঁজ সীমিত ছিল কেবল জাভা সমুদ্রেই। আজ বোর্নিওর ছোট ছোট দ্বীপেও শুরু হয়েছে তল্লাশি। ইন্দোনেশিয়ার সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে জাহাজ পাঠাচ্ছে আমেরিকা, চিন এবং দক্ষিণ কোরিয়া।
তিন দিন পর নিখোঁজ বিমানের হদিস মিললেও দুর্ঘটনা কী ভাবে ঘটল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কিন্তু কাটেনি এখনও। আবহাওয়া খুব খারাপ, ইন্দোনেশিয়ার এটিসিকে শেষ বার এমনই বার্তা পাঠিয়েছিলেন চালক ইরিয়ান্তো। বিমানটির উচ্চতা সে সময় ছিল ৩২ হাজার ফুট। ইরিয়ান্তো তা বাড়িয়ে ৩৮ হাজার ফুট করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখান দিয়ে ওই সময়ই উড়ে যাওয়ার কথা ছিল আর একটি বিমানের। তাই চালকের আর্জিতে সাড়া দিতে পারেনি এটিসি। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডার থেকে মুছে যায় কিউজেড-৮৫০১।
খারাপ আবহাওয়া দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, এমন আভাস মিলেছিল রবিবার দিনই। বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত অনেকের কথায়, জাভা সাগরের উপরের এই অঞ্চলকে ‘বজ্রপাতের কারখানা’ বলা চলে। ঘন ঘন বজ্রপাতে বিগড়ে যেতে পারে বিমানের দিগ্নির্ণয় যন্ত্রের চুম্বক। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিতে বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ইঞ্জিনেরও। বিমানের শেষ পাওয়া ছবি দেখে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই আবার ধারণা, সেই সময় বিমানের গতি অস্বাভাবিক ভাবে কমিয়ে দিয়েছিলেন চালক। কম গতির কারণেই হয়তো এয়ার পকেটে পড়ে আর শেষরক্ষা করতে পারেননি তিনি।
একের পর এক আকাশ-বিপর্যয়ের পিছনে অবশ্য আবহাওয়ার পরিবর্তনকেই দুষছেন বিজ্ঞানীরা। কয়েক বছর আগেই তাঁরা সতর্ক করেছিলেন, দূষণ রোখা না গেলে আর মসৃণ থাকবে না আকাশ পথে যাত্রা। রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক তাঁর গবেষণা পত্রে হিসেব করে দেখান, দূষণ যদি এই হারে বাড়ে, ২০৫০ সালে শুধু ইউরোপ-উত্তর আমেরিকাতেই দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
তবে কিউজেড-৮৫০১ ভেঙে পড়ার পিছনে আবহাওয়াই এক মাত্র কারণ কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ হাতে পাওয়া যায়নি ব্ল্যাক বক্স। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই আবার প্রশ্ন, একুশ শতকে এত উন্নত জিপিএস ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিমানটির হাল-হকিকত জানতে এতটা সময় পেরিয়ে গেল কেন? এডিএস-বি নামে একটি ফ্লাইট ট্র্যাকিং ব্যবস্থা ছিল এয়ারবাস ৩২০-২০০-এ। ট্র্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে সেটি সব চেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি নয় বলেই দাবি এক মার্কিন পত্রিকার।
এয়ার এশিয়ার এই বিমানের মতোই দশ মাস আগে মাঝ আকাশে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের এমএইচ-৩৭০। ভারত মহাসাগর তোলপাড় করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি তার হদিস। বিমানের সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছেন তার ২৩৯ সওয়ারি। কিন্তু এর পরেও যাত্রী নিরাপত্তা বা ট্র্যাকিং ব্যবস্থার হাল যে মোটেই বদলায়নি, প্রাণ দিয়ে বুঝিয়ে গেলেন আরও ১৬২ জন।
বিপাকে এয়ার এশিয়ার অনেক উড়ান
এয়ার এশিয়ার বিমান দুর্ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। এর মধ্যেই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনায় ফের বিতর্কে উঠে এল এয়ার এশিয়ার নাম। মঙ্গলবার সকাল ১১টা ১০ নাগাদ এয়ার এশিয়ার একটি উড়ান ব্যাঙ্ককের ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কোন কেনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। এর কিছু ক্ষণ পরেই বিমানকর্মীরা কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি লক্ষ করেন। সেই কারণে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানটিকে তড়িঘড়ি আবার ডন মুয়াং বিমানবন্দরেই ফিরিয়ে আনা হয়। তবে ত্রুটির কারণ এখনও জানা যায়নি। একই কারণে বোগোটা থেকে মায়ামিগামী এয়ার এশিয়ার আর একটি বিমানের পথ বদলে কিংসটনে অবতরণ করানো হয়। বিমানে ৯ জন কর্মী ও ১৯৭ জন যাত্রী ছিলেন। অন্য দিকে, মঙ্গলবার ম্যানিলায় অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এয়ার এশিয়ার একটি বিমান অবতরণের সময় বিপত্তির মুখে পড়ে। বিমান বন্দর সূত্রের খবর, বিমানটিতে সব সমেত ১৫৯ জন আরোহী ছিলেন। এ দিন বিমানটি ম্যানিলায় নামার সময় রানওয়ে পেরিয়ে একটি ঘাসের জমিতে আটকে যায়। নিরাপদে আরোহীদের নামিয়ে আনার জন্য আপৎকালীন একটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। হতাহতের খবর নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy