বাঙালি নিজের ঐতিহ্য নিয়ে বরাবরই সচেতন। নিজের শিকড়ের ইতিহাস জানতে অনেকেই নিয়মিত বেড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন গন্তব্যে। অবশ্য গবেষণা, বিচার বিশ্লেষণের পাশাপাশি অবশ্য একটু অন্য রকম একটা দিন কাটানোর ইচ্ছেও থাকে ষোল আনা। কলকাতা শহরের আশেপাশে তাই এমন অনেক বিখ্যাত রাজবাড়ি আপনাকে একটু ব্যতিক্রমী দিন কাটাতে সাহায্য করবে।
পুরনো কিছু বিখ্যাত বাড়িতে লুকিয়ে থাকে জানা-অজানা নানা ইতিহাস। বাংলার জমিদার বা সামন্তপ্রভুদের আদরের এই সব স্থাপত্যগুলি বেশির ভাগই এখন গর্ভে মিলিয়ে গেলেও যে ক’টি রাজবাড়ি এখনও নানা ভাবে পুনর্নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে তা দেখতে গিয়ে আপনার একটি ছুটির দিন বিশেষ মাত্রা পেয়ে যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত ইটাচুনা রাজবাড়ি নামে বাংলার এমন একটি সুন্দর প্রাসাদে। আপনি যদি সোনাক্ষী সিনহা এবং রণবীর সিংহ অভিনীত ‘লুটেরা’ দেখে থাকেন তবে বুঝতে পারবেন এটি সেই প্রাসাদ যেখানে ছবির শ্যুটিং হয়েছিল।
ইটাচুনাকে ‘বর্গী ডাঙ্গা’ নামেও ডাকা হত। নামটি ‘বর্গী’ শব্দ থেকে এসেছে যা মরাঠি যোদ্ধাদের বোঝায়, যারা কয়েক শতাব্দী আগে কর আদায়ের জন্য বাংলা আক্রমণ করে। ইটাচুনা রাজবাড়িটি ১৭৬৬ সালে শ্রী সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর পূর্বপুরুষদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। রাজবাড়িটি ২০ বিঘা জমির উপর বিস্তৃত।
কোচবিহার রাজবাড়ি ভিক্টর জুবিলি প্যালেস নামেও পরিচিত এবং এটিকে আমাদের দেশের ঐতিহাসিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই রাজবাড়িটি ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল এবং এর নকশাটি লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস দ্বারা অনুপ্রাণিত।
এই রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বারটি রোমের সেন্ট পিটার চার্চের মতো এবং ঘরগুলোর দেয়াল ও ছাদে সুন্দর চিত্রকর্ম রয়েছে। এক শতাব্দী আগের রাজপরিবার যে নান্দনিকতা এবং ঐশ্বর্য উপভোগ করেছিল তার আভাস সহজেই মিলবে এইখানে।
‘বড় বাড়ি’ বা ‘সরকার বাড়ি’ নামে পরিচিত, সুরুল রাজবাড়িটি বীরভূম জেলার একজন বিশিষ্ট জমিদার শ্রীনিবাস সরকার নির্মাণ করেছিলেন। তিনি আঠারো শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের জাহাজের জন্য পাল বিক্রি করে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন।
এই বাড়ির অট্টালিকা সংলগ্ন শিব ও লক্ষ্মীর মন্দির রয়েছে। লক্ষ্মী মন্দিরটি বাংলার পঞ্চ-রত্ন শৈলীতে নির্মিত। মন্দিরের গায়ে চমৎকার পোড়ামাটির খোদাই রয়েছে যা রামায়ণের কাহিনী চিত্রিত করে।
কাশীপুর প্রাসাদ পুরুলিয়ার অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী স্থান। পুরুলিয়া থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দুরের কাশীপুর ছিল পঞ্চকোট রাজপরিবারের আবাসস্থল যা ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চল শাসন করেছিল। মহারাজা নীলমণি সিংহ দেও ছিলেন কাশীপুরের প্রথম শাসক।
কথিত আছে যে মহারাজা নীলমণি সিংহ দেও ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং পঞ্চকোট এলাকাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। পরে তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। তিনি একটি বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন যা তার নাতি মহারাজা জ্যোতি প্রসাদ সিংহ দেও পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। পঞ্চকোট রাজবংশের তাঁকে ‘কাশীপুরের রাজা বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মুর্শিদাবাদের বড়ি কোঠি অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল। বড়ি কোঠিটি তিন-চতুর্থ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং বাড়ির অন্যান্য অংশগুলির মধ্যে একটি শীশ মহল, লাইব্রেরি, সঙ্গীত কক্ষ, দরবার হল, জানানা চক, গাদ্দি ঘর, হালওয়াই খানা, গুলাবি চাওয়ারা রয়েছে।
বাড়িটির নাম বড়ি কোঠি অর্থাৎ জ্যেষ্ঠের প্রাসাদ। কারণ এটি বড় ভাই রায় বাহাদুর বুধ সিংহ দুধোরিয়ার বাড়ি ছিল। বাড়ি কোঠি মুর্শিদাবাদ জুড়ে গ্রীক, রোমান এবং ফরাসি স্থাপত্য প্রদর্শনকারী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাড়িগুলির একটি হিসাবে পরিচিত। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের অন্যান্য প্রাসাদের মতো বাড়ি কোঠিও পরিত্যক্ত ছিল। ২০১৫ সালে এক কানাডিয়ান স্থপতি এবং পুনরুদ্ধার বিশেষজ্ঞ প্রাসাদটিকে এর আগের গৌরব ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন।
কলকাতা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে, বাওয়ালি গ্রামে, ৩৫০ বছরের পুরনো বাড়িটি এখন নান্দনিক ভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। বাওয়ালি রাজবাড়িটি বাংলার মণ্ডল পরিবারের অন্তর্গত। এখন বহু পরিচালক নিজের ছবির শ্যুটিং করার জন্য এবং খ্যাতনামীরা বিয়ে করার জন্য বেছে নেন এই রাজবাড়িটিকে।
এই সম্পত্তির বর্তমান মালিক, জনাব অজয় রাওলা, ধ্বংসাবশেষে থাকা এই জায়গাটিকে পুনরায় আবিষ্কার করেছিলেন, যিনি রাজবাড়ি বাওয়ালিকে আজকের বিলাসবহুল স্থান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য দেশ-বিদেশের স্থপতিদের সাহায্য নেন। এখন এই রাজবাড়িটি বর্ধমানের একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য।
রাজস্থানের একজন ব্যবসায়ী জনার্ধন উপাধ্যায় গর্গ মহিষাদলে ষোড়শ শতকে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিই প্রাসাদ বা রাজবাড়ি এবং মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মহিষাদল রাজবাড়ির দুটি প্রাসাদ রয়েছে। কাছারি বা কোর্ট হাউস, একটি ঘাট, একটি বৃহৎ নবরত্ন মন্দির, সবই একটি প্রতিরক্ষামূলক পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। বহু বছর ধরে ক্ষয়ে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি এখন সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে।
মহিষাদল রাজবাড়ি কলকাতা থেকে বিশেষ করে ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য সপ্তাহান্তে যাওয়ার একটি আদর্শ জায়গা। মহিষাদল রাজের ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ।একটি দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয় একটি। তাম্রলিপ্ত রাজ পরিবারের বীরনারায়ণ রায়চৌধুরী এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। এই উপাধ্যায়রা এক সময় রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।
ঝাড়গ্রাম হল পশ্চিমবঙ্গের একটি মনোরম শহর যা বেলপাহাড়ি পাহাড় এবং সুবর্ণরেখা ও কংসাবতীর মতো নদী দ্বারা বেষ্টিত। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি পর্যটকদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় আকর্ষণ। এর একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে যা মুঘল রাজবংশের সঙ্গে জড়িত।
এই রাজবাড়ি আপনাকে গথিক স্থাপত্য দেখার সুযোগ দেয়, যা ইটালীয় এবং ইসলামিক শৈলীর সংমিশ্রণ। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ঝাড়গ্রাম জেলায় অবস্থিত মল্ল দেব রাজপরিবারের বর্তমান আবাসস্থল। কলকাতা থেকে এক দিনের জন্য আপনি ঘুরে আসতেই পারেন এখানে।