Durga Puja 2020

গরম জামা রোদে দেওয়া মানেই পুজো আসছে

ভাদ্র মাসের রোদে গরম জামাকাপড়গুলোকে মেলে দেওয়া হত, ছাদের ওপর পেতে দেওয়া দু-তিনখানা মাদুরে।

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১১
Share:

আগে সব গেরস্ত বাড়িতেই, ভাদ্র-আশ্বিন মাসের চড়চড়ে রোদে, গরম পোশাক-আশাক সেঁকে নেওয়ার একটা চল ছিল। এই সময়টায় রোদ চড়া হলেও তাতে তখন বেশ কিছুটা সোনালি রং মাখামাখি। আকাশ অপূর্ব নীল। যার এ দিকে-ও দিকে সাদা মেঘের ভেলা। সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার বোঝা যেত, পুজো এগিয়ে আসছে।

Advertisement

আগে, যখন স্টিলের আলমারি সে ভাবে আসেনি, তখন দামি জামাকাপড় থাকত কাঠের তৈরি আলমারি আর লোহার তোরঙ্গে। এই তোরঙ্গ মানে হল ট্রাঙ্ক। চৌকোণা চেহারা, কিন্তু কোণাগুলো বেশ গোলালো। আর সেই কোণাগুলোয় পেতলের কাজ করা কর্নার লাগানো। সামনে পেতলের হ্যাস-বোল্ট লক। এই দু’ধরনের জায়গায় রাখা বেনারসি শাড়ি, কোট-সোয়েটার, পশমের আলোয়ান, লেপ-কম্বল এই সবে, বর্ষাকালের জোলো আবহাওয়ায় কিছু ছোট ছোট পোকা হত। এই পোকাদের কাউকে কাউকে দেখতে পাওয়া যেত, কাউকে আবার যেত না। যাদের দেখা যেত, তাদের মধ্যে দু’ধরনের পোকাকে আমার পরিষ্কার মনে আছে। যার প্রথমটির নাম ‘সিলভার ফিশ’। চ্যাপ্টা, চিংড়িমাছের মতো গড়নের এই পোকাটির গায়ের রং খাঁটি রুপোর মতো। এদের সবার মাথাতেই লম্বা দুটো শুঁড় থাকলেও, কারও কারও সুতোর মতো লেজ থাকত, কারও আবার থাকত না। এরা অসম্ভব তাড়াতাড়ি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে যেতে পারত। ধরে চিপে দিলে, আঙুলে রুপোলি পরাগের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো রং লেগে যেত।

আর দ্বিতীয় পোকাটি, ‘গরম জামাকাপড়ের পোকা’ নামেই পরিচিত। এদের সিকি ইঞ্চি লম্বা, গাঢ় খয়েরিরঙা শরীরটা, কেঁচোর মতো অনেকগুলো ছোট ছোট রিং দিয়ে তৈরি। সামনের দিক থেকে পিছনের দিক ক্রমশ সরু। নড়াচড়া করতে পারে, কিন্তু হাতে ধরলেই স্ট্যাচু। এরা গরম কাপড়ের গোছার ওপর দিয়ে ঢুকে, সেগুলো ফুটো করতে করতে নেমে, তলা দিয়ে বেরিয়ে যেত।

আরও পড়ুন: করোনাসুরকে হারাতে হবে, ‘ইমিউনিটি’ বাড়াতে কী কী খাবেন​

Advertisement


এই পোকাদের তাড়ানোর জন্য আগে কয়েকখানা করে বোঁটাসুদ্ধু শুকনো নিমপাতা, দোক্তাপাতা বা শুকনো লঙ্কা কিংবা খানিকটা করে কালোজিরে নিয়ে, একটা পরিষ্কার পাতলা কাপড়ের পুঁটলিতে ভরে, আলমারি বা তোরঙ্গের ভেতরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হত। কাপড়ের পুঁটলিতে না ভরলে, তা থেকে ভাল জামাকাপড়ে হলদেটে ছোপ-দাগ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এর পর এল ন্যাপথলিন। দুধসাদা মার্বেল গুলির মতো হালকা বল। আগের পোকা তাড়াবার জিনিসগুলোর আলাদা কোনও গন্ধ, আমরা জামাকাপড়ের গা থেকে পেতাম না। কিন্তু ন্যাপথলিনের গন্ধ পুরো আলমারি বা তোরঙ্গ জুড়ে ম’ ম’ করত। তবে এগুলো সবই কিন্তু একটা বর্ষা গেলেই নেতিয়ে গিয়ে কমজোরি হয়ে যেত। ন্যাপথলিনের বল সাইজে ছোট হতে হতে প্রায় টিকটিকির ডিমের মতো হয়ে যেত। তার পর একদম ভ্যানিশ হয়ে যেত। তখন পোকাদের দল আবার ‘হুররে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ত নিজেদের মিশন-এ। তাই বর্ষার পরেই এই রোদের ট্রিটমেন্ট ছিল একান্ত জরুরি। তারপর আবার নতুন করে পাতাপুতি গুঁজে, ন্যাপথলিন ছড়িয়ে দিয়ে আলমারি-তোরঙ্গ সব গুছিয়ে ফেলা হত।


এই সময় থেকেই খবরের কাগজ এবং রেডিয়োয় নতুন ফ্যাশনের শাড়ি ও জুতোর বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হত।

ভাদ্র মাসের রোদে গরম জামাকাপড়গুলোকে মেলে দেওয়া হত, ছাদের ওপর পেতে দেওয়া দু-তিনখানা মাদুরে। মাঝে মাঝে কাপড়গুলোর ভাঁজ বদলে বদলে দিতে হত, যাতে সব কাপড়টাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাত পায়। তখন লাল টকটকে শালু-কাপড় দিয়ে বানানো লেপের যুগ। তাই এই সময়, দূরে দূরে এক-একটি বাড়ির ছাদে শোয়ানো, লালরঙের চৌকো খোপের সংখ্যা গুণে গুণে, সে বাড়িতে ক’খানা লেপ তা ধরে ফেলা যেত। বাড়ির কত্তাদের কোট-প্যান্ট, সোয়েটার-এগুলো হ্যাঙারে করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত কাপড় শুকোতে দেওয়ার লোহার তারে।

আরও পড়ুন: রোজ পাতে মিষ্টি-চকোলেট? ‘সুইট টুথ’-এ লাগাম টানবেন কী ভাবে

আমাদের মতো একটু উঁচু বাড়ি যাদের, তারা নিজেদের ছাদ থেকে, আশপাশের বেশ কিছু বাড়ির ছাদের ওপরের এই রোদ্দুর খাওয়ানো পর্ব দেখতে পেত। এই কর্মযজ্ঞটি বেশির ভাগ বাড়ির গৃহিণীরা সামলালেও, কোনও কোনও বাড়ির নীল চেক-চেক লুঙ্গি-পরা কত্তাদেরও এতে অংশ নিতে দেখতে পেতাম। তাঁরা কাজে নামলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে চা আসত। বিস্কুট আসত। চানাচুর আসত। কেউ কেউ আবার সাময়িক দম নেওয়ার জন্য ছাদের কোণে গিয়ে ফুকফুক করে একটু ধোঁয়াও ছেড়ে আসতেন। বাড়ির কোনও কচিকাঁচা হঠাৎ ছাদে এসে পড়ে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে, সমস্ত ভাল কাপড়-জামার ওপর দিয়ে টলোমলো পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে কিংবা বাড়ির পোষা বেড়াল, মাদুরে বিছিয়ে দেওয়া কাশ্মীরি শালের নীচে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে— এ সব দৃশ্য মোটেই বিরল ছিল না।

আকছার দেখতে পেতাম, সামনের বাড়ির ছাদের একধারে, কাচের দু’খানা সাদা থালায়, কেটেকুটে শুকোতে দেওয়া ফিকে সবুজ আমলকির টুকরোর দিকে তাক করছে পাঁচিলে বসা একজোড়া যুবক কাক। কাচের মাঝারি বয়ামে কাঁচা আম, কুল বা তেঁতুলের কাদাকাদা আচার মজে উঠছে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে। সব জামা বিছিয়ে দিয়ে, ছাদ লাগোয়া সিঁড়িঘরে ছোট টেবিলপাখা চালিয়ে, টুকটুকে লাল শানের মেঝেয় বাবু হয়ে বসে কাগজ পড়ছেন কোনও এক কাকাবাবু। সামনে খোলা খবরের কাগজের পাতা জুড়ে, অজস্র নতুন জুতোর ছবি দেওয়া বিজ্ঞাপন। পাশে রাখা ‘মারফি’ রেডিয়োয়, নতুন ফ্যাশনের শাড়ি পাওয়া যাবে গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজারের কোন কোন দোকানে, তার ঘোষণা, গান ও মিউজিক সমেত চমৎকার বিজ্ঞাপন বাজছে। আর বাইরের আকাশে, কাছে এগিয়ে আসা বা সদ্য চলে যাওয়া বিশ্বকর্মা পুজোর নানা রঙের ঘুড়ি।

আরও পড়ুন:পুজোর আগেই ছিপছিপে, ২টি ব্যায়ামেই কাবু পেটের বাড়তি মেদ

এই প্রসঙ্গে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পরশুরাম (রাজশেখর বসু) বিরচিত ‘কচি সংসদ’ গল্পটির একদম গোড়ার দিকের কয়েকটি পংক্তি। ‘আলিপুরের সংবাদ-- সাগর আইল্যান্ডে বায়ুমণ্ডলে যে গর্ত হইয়াছিল সেটা সম্প্রতি পাকারকম ভরাট হইয়াগিয়াছে, সুতরাং আর বৃষ্টি হইবে না। চৌরঙ্গিতে তিনটা সবুজ পোকার অগ্রদূত ধরা পড়িয়াছে। ঘোলা আকাশ ছিঁড়িয়া ক্রমশঃ নীল রং বাহির হইতেছে। রৌদ্রে কাঁসার রং ধরিয়াছে, গৃহিণী নির্ভয়ে লেপ-কাঁথা শুকাইতেছেন। শেষরাত্রে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়। টাকায় এক গণ্ডা রোগা-রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকাইতেছে। পটোল চড়িতেছে, আলু নামিতেছে। স্থলে জলে মরুৎ-ব্যোমে দেহে মনে শরৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সেকালে রাজারা এই সময়ে দিগ্‌বিজয়ে যাইতেন।’

সবই মিলল, সবই বুঝলাম, কিন্তু হায়, আমাদের কোনওদিন দিগ্‌বিজয়ে যাওয়া হল না।

কার্টুন: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন