গোলাপজল - সৌন্দর্য্য চর্চার এক প্রাচীন ইতিহাস: পুজোর আগে ত্বকের জেল্লা ফেরাতে রূপচর্চায় গোলাপ জলের ব্যবহার এখন খুবই সাধারণ একটি বিষয়। কিন্তু, আপনি কি জানেন, ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যবহার শুরু হয় বহু বহু বছর আগে? এটি শুধু সৌন্দর্য্যের উপকরণ নয়, বরং এর রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। সুগন্ধী থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, এমনকী ঔষধ হিসাবেও এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। চলুন, জেনে নিই কীভাবে গোলাপ জল ভারতীয় রূপচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল।
গোলাপ জলের উৎপত্তি: গোলাপ জল তৈরি করার প্রক্রিয়াটি সম্ভবত পারস্য বা বর্তমান ইরানে প্রথম শুরু হয়েছিল। গোলাপ ফুল থেকে জল বের করার এই পদ্ধতিটি, যা পাতন বা ডিস্টিলেশন নামে পরিচিত, সেই সময় পারস্যের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন। এই উদ্ভাবন গোলাপের সুগন্ধী এবং ঔষধি গুণাগুণগুলিকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন: আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত আক্রমণের পর তাঁর বাহিনী, ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের মাধ্যমে পারস্যের গোলাপ জল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তবে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় মুঘল আমলে। মুঘল সম্রাটরা পারস্যের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে গোলাপ জল ভারতে নিয়ে আসেন।
মুঘলদের রাজকীয় রূপচর্চা: মুঘল বেগম এবং শাহজাদীরা গোলাপ জলকে তাদের সৌন্দর্য্যচর্চার একটি অপরিহার্য অংশ হিসাবে ব্যবহার করতেন। বেগম নূরজাহান, যিনি গোলাপের প্রতি বিশেষ দুর্বল ছিলেন, তাঁর স্নানের জলে গোলাপের পাপড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি প্রথম গোলাপ থেকে সুগন্ধী তেল (আতর) তৈরির পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন।
গোলাপ জলের বহুমুখী ব্যবহার: মুঘল যুগে গোলাপ জল শুধু ত্বক পরিচর্যায় সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো। যেমন - আহার: মিষ্টি, শরবত ও বিরিয়ানিতে সুগন্ধের জন্য। স্নান: শরীর সতেজ রাখার জন্য রাজকীয় স্নানের জলে ব্যবহার করা হত। ধর্মীয় আচার: বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রসাদ এবং উপাসনার সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করা হত।
আয়ুর্বেদে গোলাপ জল: প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদেও গোলাপ জলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন যে গোলাপ জলের শীতলতা ত্বক শান্ত করে এবং এর প্রদাহবিরোধী গুণাগুণ ত্বক সুস্থ রাখে। চোখের যত্নেও এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
ত্বকের টোনার হিসাবে ব্যবহার: গোলাপ জলের প্রাকৃতিক অ্যাস্ট্রিনজেন্ট গুণ রয়েছে। যা ত্বক টানটান ও পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখে এবং অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই প্রাচীনকাল থেকেই এটিকে ত্বকের টোনার হিসেবে ব্যবহার করা হত।
ব্রণ ও ফুসকুড়ি প্রতিরোধ: গোলাপ জলের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ব্রণ সৃষ্টিকারী জীবাণু দূর করতে সাহায্য করে। এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ ব্রণ এবং ফুসকুড়ির কারণে সৃষ্ট লালভাব এবং ফোলাভাব কমাতে কার্যকর।
মুখের যত্নে মাস্ক: হলুদ, চন্দন বা বেসনের সঙ্গে গোলাপ জল মিশিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফেস মাস্ক তৈরি করা হত। এই মাস্কগুলি ত্বক উজ্জ্বল এবং মসৃণ করত। এটি ত্বকের সতেজতা ফিরিয়ে আনতে এবং রোদে পোড়া দাগ দূর করতেও সাহায্য করে।
আধুনিক রূপচর্চায় গোলাপ জল: আজও গোলাপ জল রূপচর্চার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাণিজ্যিক বিউটি প্রোডাক্ট থেকে শুরু করে ঘরোয়া রূপচর্চায় এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এর ইতিহাস ও কার্যকরিতার কারণে এটি আধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।