সুরের ঝর্ণায় ভেসে যাচ্ছে বিরাট বাড়িটা। ধ্রুপদী সঙ্গীতের রানী কেসরবাঈ দেশ রাগের ওপর তান বিস্তার করছেন। পুজোর আর কিছুদিন মাত্র বাকি। ঠাকুর দালানে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। খিলানের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ঠাকুরের গায়ে। সুরে তালে আর পুজোর গন্ধে মিলেমিশে যেন গন্ধর্বলোক নেমে এসেছে পাথুরিয়াঘাটার বাড়িটাতে। এমন সঙ্গীতের আসর অবশ্য প্রায়ই বসে এখানে। কে আসেননি এই বাড়িতে? ওস্তাদ আলাদিয়া খান, বড়ে গুলাম আলি , গহরজান, বিষ্ণু পালুস্কর, আব্দুল করিম খান বিভিন্ন সময়ে এসেছেন, অনুষ্ঠান করেছেন। তিরিশ এর দশকের শুরুতে ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এর প্রাথমিক চিন্তাভাবনাও শুরু হয় এখান থেকেই। যে বাড়ির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে রয়েছে গান, মিশে আছে সুর, সেই বাড়ির পুজো তো আর সুর ছাড়া হয় না ! রামলোচন ঘোষ বাড়ির পুজো শুরু হত সানাই আর ঢাকের মিলেমিশে যাওয়া ছন্দে। নহবতখানায় মহালয়া থেকেই ভোরবেলায় তান ধরত সানাই। সপ্তমীর দিন পুজো শুরুর জানান দিয়ে বেজে উঠত ঢাক। বাড়ির সদস্যরা আধো ঘুম ছেড়ে নীচে নেমে এসে দেবী প্রণাম করতেন।
আনুমানিক ১৭৮৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান রামলোচন ঘোষ এই বাড়ির দুর্গা পুজো শুরু করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস সস্ত্রীক এসেছিলেন ঘোষ বাড়ির পুজো দেখতে। উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু হয়। মঠচৌরি শৈলীতে তৈরি করা হয় ঠাকুর। ডাকের সাজ থাকে পরনে। চালচিত্রে থাকেন কৃষ্ণ, কালী, জগদ্ধাত্রী। পটশিল্পী আগে আসতেন কলকাতার বাইরে থেকে। নিপুণ তুলির টানে একের পর এক দেবদেবী আর লোকগাথার ছবি ফুটে উঠত পটে। এখন আর সেই সব শিল্পী আসেন না। স্থানীয় শিল্পীরাই পট আঁকেন। প্রতিপদের দিন বোধন হয় এই বাড়িতে। প্রতিপদ থেকে নবমী প্রতি দিন হয় চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরের চক্ষুদান করা হয় নিয়ম মেনে।
ঘোষ বাড়ির পুজোর সব অনুষ্ঠান হয় ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে, যাতে শুভসময়ের এক চুল এদিক ওদিক না হয়। অঞ্জলি দেওয়ার প্রথার সঙ্গে পরিবারের প্রাচীন রীতি আজও জড়িয়ে আছে। আগে যখন অন্তঃপুরের বাইরে মেয়েদের পা দেওয়ার নিয়ম ছিল না তখন মেয়েরা বাড়ির ডানদিকের সিঁড়ি দিয়ে অন্দরমহল থেকে ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে ঠাকুরদালানের ডানদিকে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য দাঁড়াতেন। পুরুষরা বাইরে কাজকর্মে থাকতেন। তাঁরা ঠাকুরদালানের বাঁ দিকে এসে দাঁড়াতেন অঞ্জলির সময়। এখন আর মেয়েরা অন্তঃপুরে আবদ্ধ নন। কিন্তু পুরনো দিনের মত একখনও তাঁরা শুধুমাত্র ঠাকুরদালানের ডানদিকেই দাঁড়ান পুজোর সময়। বাড়ির পুরুষরা অন্য দিকে দাঁড়ান।
আরও পড়ুন: ১৯৬ বছরের এই পুজোয় দেওয়া হয় ২৮ কিলোগ্রামের নৈবেদ্য
আগে পাঁঠাবলি দেওয়া হত। এখন আর পাঁঠাবলি হয় না। তার বদলে সপ্তমী অষ্টমী আর নবমীতে চাল কুমড়ো আর আখ বলি দেওয়া হয়। এই বাড়ির ভোগ হয় দেখার মত সুন্দর। হরেক রকম থালায় ভোগ সাজিয়ে দেওয়া হয়। বিরাট বড় বড় মার্বেলের থালায় দেওয়া হয় ফল। রূপোর থালায় মিষ্টি। সুন্দর কারুকাজ করা বিরাট থালায় দুই মন চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয় নানা ফল দিয়ে সাজিয়ে। পাঁচকলাই আদা কুচি আর সৈন্ধব লবন দেওয়া হয় তামার থালায়। অন্নভোগ হয় না এই বাড়িতে। ঠাকুরকে নানা ধরনের মিষ্টি দেওয়া হয়। চন্দ্রপুলি, নানা রকম নাড়ু, মুগের বরফি, পেস্তার বরফি এ সবই ঠাকুরের ভোগ হয়। আগে ভোগ তৈরির জন্য পঞ্চমী থেকে ভিয়েন বসত বাড়িতে। এখন অবশ্য মিষ্টি বাইরে থেকেই কেনা হয়। ঘোষ বাড়িতে ঠাকুরকে বিশেষ করে চকলেট সন্দেশ ভোগ দেওয়ার রীতি চালু হয়েছে কিছুদিন। শীতল ভোগে ঠাকুরকে লুচি মিষ্টি আর চন্দনী ক্ষীর দেওয়া হয়। বিরাট রূপোর থালায় রাখা রক্ত চন্দনের ছিটে দেওয়া ফুল দিয়েই শুধুমাত্র ঠাকুরের পুজো হয়। পুজো শুরুর আগে বিরাট এক মোম জ্বালান হয়। দক্ষিণান্ত পর্যন্ত সেই মোম যাতে কোনও মতেই না নিভে যায়, সেই দিকে খেয়াল রাখেন বাড়ির সদস্যরা।
আরও পড়ুন: এখনও কামান দেগে পুজো শুরু হয় নরসিংহ চন্দ্র দাঁ পরিবারের
রামলোচন ঘোষের বাড়িতে পুজোর বহু আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। ভরা বাড়ি সেজে উঠত নতুন করে। ঘরদোর পরিষ্কার করে নতুন রংয়ের পোঁচ দেওয়া হত ঠাকুর দালানের দেওয়ালে। বাড়ির মহিলারা পুজোর জন্য চন্দনের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করতেন ধুপের মশলা। মোটা করে সেই মশলা কাঠির গায়ে দিয়ে শুকোতে দেওয়া হত। ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে প্রস্তুত হত ঢেঁকি ছাঁটা চাল। আত্মীয় স্বজনরা যখন পুজোর মরসুমে আসতেন বাড়িতে, সেই সময় কাজে লাগত এই চাল। বিরাট বাড়ির কোনওটা ছিল পান সাজার ঘর কোনওটা আবার তরকারি কাটার ঘর। পুজোর সময়ে রাশি রাশি পান সেজে রূপোর থালায় স্তুপ করে রাখা হত। মেয়েদের বাইরে বেরনোর অনুমতি ছিল না। অন্দরমহলের এক উঠোন থেকে অন্য উঠোন দখল করে নিত মহিলামহল। ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী নিরামিষ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। নবমীর দিন মাছের তিন চার রকম পদ, পাঁঠার মাংস, আর নানা মিষ্টি সহযোগে বিরাট ভোগের আয়োজন হত। সেদিন সকলের জন্য অবারিত দ্বার ছিল এই বাড়ি। রাতে গানের আসর বসত। সারা রাত চলত গান। দশমীর দিন জোড়া নৌকায় ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফেরার পর বাড়ির সদস্যরা বিজয়া করতেন। নবমীর ভোজ আজও হয় , কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ির মধ্যে এই একটি বাড়িতে আজও জোড়া নৌকায় বিসর্জন হয়। কিন্তু নবমীর রাতের সেই গানের আসর আজ আর বসে না। সঙ্গীতশিল্পীদের দুষ্প্রাপ্য ছবিতে এ মোড়া গানঘর নিঃঝুম পড়ে থাকে সারারাত। তবু সুর যে এখনও ছেড়ে যায় নি এই বাড়িকে সেটা বোঝা যায় যখন নবমীর গভীর রাতে গ্রামোফোনে বেজে ওঠেন আবদুল করিম খান, ‘পিয়া বিনা চেইন নেহি আওয়াত...!!’
ছবি: সংগৃহীত।