১৬১০ সালে শুরু। কাঠের থামের উপর হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা মণ্ডপে দেবী আরাধনা শুরু হয়।
বৃষ্টিধোয়া আকাশে আস্তে আস্তে সোনা রং লাগছে। দিঘিতে টলটল করছে জল। কাশের বন ভেসে যাচ্ছে শরতের হালকা হিমেল হাওয়ায়। ঝকঝকে তকতকে নিকানো উঠোন গ্রামটার। আল্পনা দেওয়া তুলসি মঞ্চ। এই এলাকার সবথেকে বর্ধিষ্ণু গ্রাম এই বড়িশা। গ্রামবাসীদের এ বার বড় আনন্দ। এই গ্রামে এই বছর থেকে দুর্গাপুজো শুরু করছেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী। গ্রামে উচ্চবর্ণের হিন্দু, নিম্নবর্ণের হিন্দু আর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ মিলেমিশে থাকেন। প্রজাদের মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এক সূত্রে বেঁধে রেখে মসৃণ ভাবে নবলব্ধ দায়িত্ব পালনের জন্য এমন একটি পুজোর যে বিকল্প নেই সে কথা বিলক্ষণ জানেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।
বারো ভুঁইয়ার সময় যখন বাংলার রাজনীতির আকাশে নানা পটপরিবর্তন হচ্ছে, লক্ষ্মীকান্তের উত্থান সেই সময়। তখন কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চল ছিল যশোহরের মধ্যে। আর এই যশোর এস্টেটের দায়িত্বে ছিলেন বারো ভুঁইয়ার বসন্তরায় এবং বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্যর পুত্র প্রতাপাদিত্য এবং লক্ষীকান্ত, দু’জনেই ছিলেন অমায়িক, সদাহাস্যমুখ বসন্তরায়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ। লক্ষ্মীকান্ত ছিলেন যশোর এস্টেটের মহামন্ত্রী। বিক্রমাদিত্য মারা যাওয়ার সময় পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ যশোহরের দিক পেলেন প্রতাপ, পশ্চিম দিক পেলেন বসন্তরায়। পিতার মৃত্যুর পর চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটল প্রতাপের। অত্যন্ত স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন তিনি। হত্যা করলেন পিতা সমান বসন্তরায়কে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বউঠাকুরানীর হাট’ এই প্রতাপাদিত্য আর বসন্তরায়েরই ভালবাসা ঘৃণা ঔদ্ধত্য আর স্নেহের আনন্দ-বেদনার কাহিনি। এর কিছু দিনের মধ্যেই প্রতাপকে দমন করতে মানসিংহকে পাঠান আকবর।
প্রতাপ পরাজিত হলে ১৬০৮-এ লক্ষ্মীকান্তকে হালিশহর থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি স্বত্ত প্রদান করেন মানসিংহ। সেই সঙ্গে পান রায়চৌধুরী উপাধি। এর আগে হালিশহরে বছর দু’য়েকের জন্য দুর্গাপুজো করলেও এ বার বড় আকারে বড়িশাতে পুজো শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী। কিছু কিছু গবেষকের মতে, এর আগে তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বা ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণের পুজোর যে বর্ণনা পাওয়া যায় সেখানে দেবীমূর্তির সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী বা কার্তিক, গণেশ ছিলেন না। দেবীকে মূলত চণ্ডীরূপে পুজো করা হত। এই প্রথম দেবীকে সপরিবার আবাহন করলেন লক্ষ্মীকান্ত। কার্তিকের চেহারায় কিছু পরিবর্তন আনা হল। পণ্ডিতরা বিধান দিলেন, দেবীর গায়ের রং হতে হবে স্বর্ণাভ বা শিউলি ফুলের বোঁটার মতো।
১৬১০ সালে শুরু। কাঠের থামের উপর হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা মণ্ডপে দেবী আরাধনা শুরু হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ষোলোটি থামবিশিষ্ট একটি নাটমন্দির। সেই সব সোনালী দিনের বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। কিন্তু আজও দেবী শরতের সোনা রং গায়ে মেখে সাবর্ণ পরিবারে আসেন। তাঁর গাত্রবর্ণ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। লাল বেনারসী আর নানা অলঙ্কার অঙ্গে ধারণ করেন তিনি। গণেশের গায়ের রং হয় লাল। অসুরের সবুজ। দেবীর এক দিকে থাকেন রঘুপতি, অন্য দিকে শিব।
আরও পড়ুন: নবমীতে রাতভর মজলিশ নেই, তবে জোড়া নৌকায় বিসর্জন আজও ঘোষবাড়ির ঐতিহ্য বয়ে চলেছে
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের মোট আটটি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। প্রধান পুজোটি হয় বড়িশা আটচালায়। বাকি পুজোগুলি হয় আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি, কালীকিঙ্কর ভবনে। এ ছাড়াও বিরাটিতে ও নিমতা পাঠানপুরের সাবর্ণবাড়িতে পুজো হয়। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী মতে, অর্থাৎ তন্ত্রমতে দেবীর পুজো হয়। এই পরিবারের সদস্য দেবর্ষি রায়চৌধুরী জানান, লক্ষ্মীকান্তের নাতি বিদ্যাধর রায়চোধুরীর সময় এই পরিবারের পুজোতে ত্রিধারাসঙ্গম হয়। অর্থাৎ, শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব— এই তিন মত মিলে যায় পুজোতে।
এই কারণেই এই পুজোর চালচিত্রে রয়েছেন ছিন্নমস্তা, বগলা, কমলাকামিনী, মাতঙ্গী, অর্থাৎ দশমহাবিদ্যা এবং সেই সঙ্গে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি ও নিমতার বাড়িতে সিংহের মুখ হয় ঘোটক আকৃতির। যা বৈষ্ণব মতানুযায়ী হয়। বাকি বাড়িতে সিংহের মুখ হয় সিংহের মতোই। বড় বাড়ি এবং বিরাটি বাড়িতে নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো। এ-ও হয় বৈষ্ণব মতে। আটচালা বাড়িতে ষষ্ঠীর তেরো দিন আগে থেকে দেবীকে আবাহন করা হয়। পাশেই রাধাগোবিন্দ মন্দিরে আছে বোধন ঘর। সেখানে দেবীর বোধন শুরু হয়। তিন বেলা ভোগ দেওয়া হয় এই সময় দেবীকে। সকালে ফলমূল, দুপুরে অন্নভোগ আর রাতে লুচি। মহালয়ার পরের দিন বেদী করে সেখানে পঞ্চঘট বসানো হয়। পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে গণেশ ও শান্তির আরাধনা করা হয়। সপ্তমীর দিন যখন পুজো শুরু হয় তখন এই ঘট থেকে মাটি নিয়ে গিয়ে প্রতিমার সামনে মূল ঘটে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়।
আরও পড়ুন: ১৯৬ বছরের এই পুজোয় দেওয়া হয় ২৮ কিলোগ্রামের নৈবেদ্য
সাবর্ণ পরিবারে কলাবৌ স্নান সপ্ততীর্থের জল দিয়ে আটচালাতেই করানো হয়। আটচালাতেই একমাত্র কৃষ্ণানবমী কল্পারম্ভে পুজো হয়। অন্য পুজোগুলি শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন থেকে। অষ্টমী এবং নবমীর দিন এই বাড়িতে একটি বিশেষ পুজো হয়, ‘মাস ভক্ত বলি। ১৮০টা খুড়িতে মাসকলাই এবং দই দিয়ে এই পুজো করা হয় অপদেবতা আর উপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতে যাতে তারা পুজোয় কোনও বিঘ্ন ঘটাতে না পারে।
আগে এই বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল এবং একটি মোষ বলি হত। এখন পশুবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে কুমড়ো, শশা এই সব বলি হয়। সাবর্ণদের বাকি বাড়িগুলিতে আমিষ ভোগ হলেও নিমতার বাড়িতে সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ হয়। এই বাড়িতে ঠাকুরের ভোগের নানা বাহার। বোধনের পর থেকে এক এক দিন এক এক বাড়িতে দেবীর ভোগ রান্না হলেও সপ্তমীর দিন থেকে পরিবারের মহিলারা একসঙ্গে ভোগ রাঁধেন। সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি— এক এক দিন এক একটা জিনিস রান্না করা হয়। এর সঙ্গে শুক্তো, মুগের ডাল, মোচার ঘণ্ট, লাউ, সবই রান্না করা হয় দেবীর জন্য। এ ছাড়াও দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয় বলে রুই, ভেটকি, পার্শে, বাটা, ইলিশ— এমন পাঁচ রকমের মাছ থাকে প্রতি দিন। আর থাকে চাটনি, পায়েস, পাঁচ-ছয় রকমের মিষ্টি। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজো চলাকালীন তৈরি করতে হয় খিচুড়ি, ল্যাটামাছ আর কাঁচকলা পোড়া। দশমীর দিন পান্তাভোগ হয় প্রতি বার। নবমীর দিন রাতে রান্না করে রাখতে হয় খেসাড়ির ডাল, চালতার অম্বল, কচুশাক আর কইমাছ। দশমীর দিন সকালে ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয় এগুলি। রাতে লুচি করা হয়। এর সঙ্গে থাকে বেগুনভাজা, পটলভাজা, ছানার ডালনা।
এই পরিবারে বিজয়া একটু অন্য রকম ভাবে হয়। দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে ঠাকুরের সামনেই শুরু হয় বিজয়া পর্ব। চণ্ডীমণ্ডপে প্রণামের রীতি, কিন্তু এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য, এই নিয়মের চল অন্য কোথাও নেই। আগে ঠাকুর টলিনালায় বিসর্জন হত। বর্তমানে অন্য ঠাকুরের মতোই বাবুঘাটে বিসর্জন হয়।