Durga Puja 2019

বউভাতের দিন বসুমল্লিক পরিবারে নববধূকে পরানো হয় মা দুর্গার বেনারসি

সপ্ততীর্থের জল আর পদ্মরেণুতে স্নান করানো হয় নবপত্রিকাকে

Advertisement

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ১৫:৪০
Share:

সারা বছর পুরনো কলকাতার গলিঘুঁজির মধ্যে মুখ লুকিয়ে থাকে বাড়িটা। ঠাকুরদালানের দেওয়ালে খোদাই করা কারুকাজ, আঙিনায় ঢালাই লোহার মূর্তি ঢেকে যায় ধুলোয়। জীর্ণ ঝুলবারান্দা বিবর্ণ দেওয়ালের সারি অতীত গৌরবের মুখ ঢেকে দিতে চায় যেন। তাও তো আলো বিচ্ছুরণ করে রঙিন কাচ। ইতিহাস আজও বাঙ্ময় এখানে। স্বদেশি আন্দোলন ও সেই সময়ের ইতিহাসে বসুমল্লিক পরিবারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯০৫-এর ২৭ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ির ঠাকুরদালানে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেন। কংগ্রেসের চরমপন্থী আন্দোলনের নেতা রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক এই বাড়িরই সদস্য ছিলেন। বসুমল্লিক পরিবারের ঠাকুরদালানে আয়োজিত হত সে যুগের অন্যতম সঙ্গীত-নৃত্যের অনুষ্ঠান ‘শঙ্কর উৎসব’।

Advertisement

তবে এই বাড়ির ইতিহাস আরও প্রাচীন। গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের উজির গোপীনাথ বসু এবং তাঁর বড় ভাই বল্লভ সুলতানের কাছ থেকে পুরন্দর খাঁ মালিক এবং সুন্দরবর খাঁ মালিক উপাধি লাভ করেন। পুরন্দর খাঁ নানা সমাজ সংস্কার করেন। এর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল কায়স্থদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথার সংস্কার। কোনও কোনও গবেষকের মতে এরই ফলে পরবর্তীকালে কায়স্থদের মধ্যে বহুববিবাহ ব্রাহ্মণদের থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কমে যায়।

মালিকরাই পরবর্তীকালে মল্লিক হয়ে যায়। পাঠানদের মুঘলরা ক্ষমতায় এলে শুরু হয় মোগল পাঠান দ্বন্দ্ব। সেই সময় এঁদের একটি শাখা হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছে কাঁটাগড় গ্রামে চলে আসে। কাঁটাগড় থেকে এই পরিবারের রামকুমার বসুমল্লিক কলকাতায় আসেন। রামকুমার বসুমল্লিকের পেশা যজমানি হলেও ছেলে রাধানাথ মল্লিক ইংরেজি শেখেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হন। সেই সময় কলকাতায় জাহাজ সংক্রান্ত ব্যবসার রমরমা। জাহাজে মাল সরবরাহের কাজ করতে করতে একটি বিদেশি সংস্থার অংশীদার হলেন রাধানাথ। তাঁর দক্ষতায় কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানি প্রচুর লাভ করতে শুরু করল। সাহেব দেশে ফিরে যাওয়ার সময় কোম্পানিটি বিক্রি করে দিলেন রাধানাথকে। সালকিয়ার হুগলি ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন ইনিই। অত্যন্ত অল্পবয়সে রাধানাথ যখন মারা যান তখনই তিনি কলকাতার অন্তত চল্লিশটি বাড়ি, প্রচুর জমিজমা এবং ধনসম্পত্তির মালিক। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে সেইসময়ের পঞ্চাননতলা লেন অর্থাৎ বর্তমানে যেটি রাধানাথ মল্লিক লেন সেখানে বাড়ি কিনে দুর্গাপুজো শুরু করেন রাধানাথ।

Advertisement

আরও পড়ুন: পুজোয় ভবানীপুর মল্লিকবাড়িতে শুধু দশমীতেই আমিষ, থাকে মেটে চচ্চড়ি​

আদি বাড়িটির পুজো ছাড়াও ২২ নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেন ৪৬ নম্বর শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে এই পরিবারের দুটো শরিক বাড়ির পুজো হয়।

বসুমল্লিক বাড়িতে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন। একচালার মূর্তিতে ডাকের সাজ থাকলেও দুর্গা লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশকে বেনারসী ও সিল্কের শাড়ি পরানো হয়। এখানে সিংহের মুখ ড্রাগনাকৃতি। বসুমল্লিক বাড়িতে মহালয়ার পরের দিন দেবীর বোধন হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে বরণ করার পর শুরু হয় মূল প্রতিমায় পুজো। এই বাড়ির পুজোর বৈশিষ্ট্য হল কলাবউকে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয় না। বাড়িতেই স্নান করানো হয় সপ্ততীর্থের জল আর পদ্মরেণু দিয়ে। আগে প্রচলন থাকলেও এখন আর পশুবলি হয় না। এই বাড়ির একটি প্রাচীন প্রথা হল কাদামাটি খেলা। আগে বলির পর কিছু বাচ্চা ছেলে গায়ে কাদামাটি মেখে ঢাকের বোলের সঙ্গে নেচে নেচে এই এলাকার পুজোর বাড়িগুলিতে ঘুরত, মহিষাসুর বধের পর দেবীর বিজয় পালন করত তাঁরা উল্লাস করে। এখন সময় বদলেছে। সেই বাচ্চাগুলি এখন আর আসে না, তাই কাদামাটি খেলাও আর হয় না।

আরও পড়ুন: ঘোষবাড়ির অন্দরমহলে দুর্গোৎসবের ধূপটুকুও সুগন্ধি পিষে তৈরি হয়​

২২ নম্বর বাড়িটির পুজো শুরু হয় ক্ষেত্রচন্দ্র বসুমল্লিকের আমলে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। তুলনামূলকভাবে পরে তৈরি হয়েছে বলে এই বাড়িতে ঠাকুরদালানে ভারি সুন্দর ঢালাই লোহার কাজ চোখে পড়ে। অন্য বসুমল্লিক পরিবারগুলির মত রথের পরই গরান কাঠ পুজোর পর এই বাড়িতে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। বোধনের পর শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। মহাষষ্ঠীর বরণ হয় আড়ম্বর করে। রুপোর কুলো, বরণডালা আর শ্রী সাজিয়ে নিয়ে আসেন বাড়ির মেয়েরা। সপ্তমীর দিন বাড়ির গৃহলক্ষ্মীকে নিয়ে আসা হয় নীচে ঠাকুরদালানে। সাথে আসেন মধুসূদন, অষ্টধাতুর গোপাল আর কিছু শিবমূর্তি। দেবীর সঙ্গে এঁদেরও পুজো হয় প্রতিদিন। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। ঠাকুরকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না কোনও বসুমল্লিক বাড়িতেই। লুচি নানা রকম ভাজা, নাড়ু, বোঁদে, গজা, নিমকি, নাড়ু, মোহনভোগ, ক্ষীর, মেওয়া, খেজুর, আখরোট, আরও নানা রকম মিষ্টি দেওয়া হয় ভোগে। সন্ধিপুজোর দিন থালায় চাল চূড়ো করে সেটিকে আখ আর কলা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। অষ্টমীর দিন আনারস, ছাঁচি কুমড়ো, আখ আর রাবড়ি প্রতিমার সামনে সাজিয়ে দেওয়া নিয়ম এই বাড়িতে। এছাড়া বাতাবিলেবু, নারকেল পাঁচকলাই দেওয়া হয় ঠাকুরকে।

বসুমল্লিকদের আদি বাড়িতে পুজোর প্রতিদিনই সিঁদুরখেলা হয়, দেবী চণ্ডীর মেটে সিঁদুর এবং দুর্গার লাল সিঁদুর দিয়ে। বিসর্জনের আগে দেবীর বেনারসী খুলে নেওয়া হয়। বাড়িতে নতুন বউ এলে বউভাতের দিন সেই বেনারসি পরানো হয় তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন