প্রতীকী চিত্র
দেবীর পায়ে আছড়ে পড়লেন বৃদ্ধ ঘোষাল ঠাকুর। মাগো, যদি সন্তান দিলে, তা হলে এমন করে অসুখ কেন দিলে! সন্তান যদি সুস্থ না হয়, তা হলে তোমার পুজো করবে কে? তুমি নিত্য ভোগ-জল পাবে না। সেবা পাবে না। বুড়ো বয়সে সেই দিন কি আমাদের দেখে যেতে হবে?
বড় সাধ করে তোমাকে ঘরে এনেছি মা। যত ক্ষণ তোমার দেওয়া এ প্রাণ আছে, তোমাকে সেবা দিয়ে যাব। কিন্তু তার পরে যদি তোমার সেবা না হয়, আমি যে পরপারে গিয়েও শান্তি পাব না গো মা.... বৃদ্ধ ঘোষাল ঠাকুরের আকুতি হাহাকারের মতো আছড়ে পড়ে ঠাকুরদালানের দেয়ালে। আর দেবী! তিনি কি ডাক উপেক্ষা করতে পারেন? তিনি কি চুপ থাকতে পারেন? লোকে বলে– মা যখন শাসন করেন, সন্তান যতটা কাঁদে, তার বহু গুণ কাঁদেন তার মা। সত্যিই তাই, তাই তো তিনি মা।
সেই রাত্রে ঘোষাল ঠাকুর স্বপ্ন দেখলেন, দেবী এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বাড়ির উঠোনে! মুখখানা একই, কিন্তু তিনি তাঁর গৃহের চিরাচরিত দশভুজা রূপে আসেননি। সে বড় অদ্ভুত রূপ! তিনি কেবল আনন অর্থাৎ মুখমণ্ডল স্বরূপা! হাত-পা কিছুই নেই। মা বললেন, এই রূপেই আমার পূজা কর তোরা!
পরদিন চতুর্দিকে খোঁজ শুরু হল। কিন্তু এমন রূপের সন্ধান কোথাও তো পাওয়া যায় না। আবার দেবীর কাছে কেঁদে পড়েন ঘোষাল ঠাকুর। মাগো এমন রূপ কোথায় পাব! সামনেই যে দুর্গাপুজো, তোমার পুজো হবে। এমন সময়ে এ মূর্তি কে-ই বা গড়ে দেবে? আর সময়ই বা কই?
সেই রাতে আবার স্বপ্নাদিষ্ট হন ঘোষাল ঠাকুর। দ্বারকেশ্বরের যে দহ তৈরি হয়েছে, তার পাড়ে পাবে আমার মূর্তি। আর ওই দহের জলের প্রোথিত রয়েছে আমার খড়গ। সেই খড়গ দিয়েই বলিদান সম্পন্ন করবে নবমীর দিন। এ বার থেকে পূর্ণ শাক্ত মতে শুদ্ধাচারে হবে তোমাদের দুর্গাপূজা। আমি এই রূপেই এ বার থেকে পূজা পাব।
***
এই কাহিনি প্রায় তিনশো বছর আগের। ছাতনার রাজার থেকে তালুক পেয়ে কানকাটা নামক স্থানে নিজেদের বসতি করেছেন ঘোষালরা।
মায়ের আশীর্বাদে এবং রাজানুগ্রহে তাঁদের জমিদারি প্রসারিত হল। আশেপাশে বিভূত মানুষজনকে জমি প্রদান করে বসালেন তাঁরা। বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেন। সবই হল। কিন্তু বংশে কিছুতেই পুত্রসন্তান জন্মায় না। সকলেই কন্যাসন্তান। তাদের বিয়ে দিতে হবে। তা হলে এই পুজো হবে কী করে? কারণ বংশের মানুষের হাতেই এই পুজো হওয়ার বিধি। মায়ের কাছে নিত্যদিন প্রার্থনা করেন তাঁরা। অবশেষে এক পুত্রসন্তান জন্মায়। কিন্তু সে সন্তান মুমূর্ষু! যে কোনও মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে অঘটন!
মায়ের কাছেই আছড়ে পড়লেন ঘোষালরা। হাহাকার, ক্রোধ, অভিমান, আকুলতা অশ্রু হয়ে স্পর্শ করে গেল মাতৃহৃদয়। দেবী দর্শন দিলেন। সেই সঙ্গে এল তাঁর নির্দেশ।
সেই সময়ে বন্যার পরে দ্বারকেশ্বরের মধ্যে দহ বা জলবেষ্টিত স্থানের সৃষ্টি হত। এই কিছু কাল আগেও যখন দ্বারকেশ্বর পূর্ণ নাব্য ছিল, তখনও হত। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নৌকা করে দহের পাড়ে গিয়ে পৌঁছন ঘোষালেরা। কী আশ্চর্য! পাড়ে মেঘমুক্ত আকাশের নীচে এক মাতৃমূর্তি! ভূজবিহীন প্রতিমা। যেন মূর্তিটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে কেউ পুজোর জন্যই রেখে গিয়েছে। আর সেই দহের জলের তলা থেকে পাওয়া গেল খড়গ।
প্রবল বন্যার পরে এই জনবিরল স্থানে কী ভাবে এল এই মাটির প্রতিমা! অবশ্য তিনি চাইলে কী না হয়!
এক দিকে দেবীর বোধন হল, আর অন্য দিকে সেই শিশুপুত্র ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। জয়ধ্বনি উঠল দেবীর নামে। সর্বত্র প্রচারিত হল কানকাটা ঘোষাল বাড়ির অদ্ভুত মাতৃমূর্তির মহিমা।
দেবী দুর্গা দশভূজা রইলেন অন্তরে, কিন্তু বাইরে তিনি এই অদ্ভুত রূপেই রইলেন।
***
সেই সঙ্গে পুজোর কিছু বিশেষ বিধি হল। আদি যে মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল, সেটি পুজোর পরে বিসর্জন হয় দশমীর দিনে। বিসর্জিত হয় দেবীর ঘট, নবপত্রিকা। পরের বছর থেকে সেই মূর্তির আদলেই গড়া হতে থাকল প্রতিমা। দেবী দুর্গা এমন রূপে প্রতিষ্ঠা পেলেন।
মাতৃমূর্তিতে যে শাড়ি পরানো হবে, সেই শাড়িতে কোনও ছুরি-কাঁচি পড়ে না। তাঁতি স্নান সেরে এসে শুদ্ধ বস্ত্রে তাঁত যন্ত্র পুজো করে কাজে বসেন। সুতোর পর সুতো গিঁট মেরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠে শাড়ি। সেই তাঁতিরা আজ ১২ পুরুষ ধরে দেবীর শাড়ি দিয়ে আসছেন।
তেমনই প্রতিমা শিল্পী সোনামুখীর পালেরা আজ ১২ পুরুষ ধরে দেবীর এই বিশেষ মূর্তি গড়ে চলেছেন। পুজোর আতপ চালের জন্য নির্দিষ্ট আছে দেবোত্তর জমি, তা-ও বংশানুক্রমে চাষ করে এক নির্দিষ্ট কৃষক পরিবার। নির্দিষ্ট কুমোর পরিবারটি বংশানুক্রমে গড়ে যায় দেবীর ঘট। আসলে এ সবই মাতৃসেবা।
আজও একই ভাবে দশমীর দিন মূর্তির সঙ্গে ঘট বিসর্জিত হয়। যা খানিক ব্যতিক্রমও বটে।
***
দিন যায়। মায়ের পুজো হয় সাড়ম্বরে। পুত্র এখন সুস্থ। তার পৈতে দেওয়া হল। তাকেই তো করতে হবে বংশের পুজোপাঠ।
কিন্তু পৈতের পরেই ঘটে গেল অঘটন। আবার অসুস্থ হল সেই পুত্র। পঙ্গু হয়ে পড়ে রইল বিছানায়।
তবে এ বারে আর দেবী কঠিন পরীক্ষা নিলেন না। স্বপ্ন দিলেন যে, ওই পুত্র সুস্থ হবে। বিশেষ বিধান দিলেন তিনি, ঘরে তৈরি বিশেষ ঘি এবং তার সঙ্গে বলির পরে উৎসর্গীকৃত রক্ত মিশিয়ে মালিশ করতে হবে। আর এই দিব্য ওষুধ শুধু তাঁদের জন্য নয়, সকলের জন্য।
আজও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ এসে পক্ষাঘাতগ্রস্তের জন্য এই ওষুধ নিয়ে যান। এ দেবীর দান, মায়ের স্নেহ– এতে সবার ভাগ।
তবে হ্যাঁ, পুত্রসন্তান মা দেন মেপে মেপে। আজও এই সুপ্রাচীন ঘোষাল পরিবার চারটি পরিবারের বেশি বিস্তার পায়নি। সুবিশাল গ্রামটিতে তাঁরা বহু মানুষদের বসিয়েছেন। নিজেদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দৌহিত্রদের পরিবার নিয়ে মস্ত পরিবার। কিন্তু ঘোষালরা কেবল ওই চারটি পরিবার। আর মায়ের পুজোর জন্য প্রতি পুরুষে কয়েকটি পুত্রসন্তানে সীমাবদ্ধ রয়েছেন তাঁরা। কী আশ্চর্য না?
বাঁকুড়ায় যেখানে পণের দারুণ প্রাদুর্ভাব, সেখানে দেবী যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চলেছেন, আমার সবচাইতে প্রিয়, আমি নিজেই যে কন্যা!
তথ্য ঋণ- ঘোষাল বাড়ির বর্তমান পুরুষ নিমাই ঘোষাল।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।