প্রতীকী চিত্র
শ্রী শ্রী চণ্ডীর সপ্তম অধ্যায় বলছে, শুম্ভের নির্দেশে তার দুই অগ্রজ ও সেনাপ্রতি চণ্ড ও মুণ্ড দেবী দুর্গার দিকে ধাবিত হলেন। তাদের সঙ্গে প্রচুর অশ্ব ও হস্তি বাহিনী, অথচ দেবী সিংহপৃষ্ঠে একা। সেই দেখে তাদের মনে হল, খুব সহজেই জয় হবে এই যুদ্ধে।
হাসিতে ফেটে পড়লেন অসুরেরা। দেবী তা দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। ক্রোধে তাঁর গৌরবর্ণ দেহ লাল, পক্ষান্তরে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল। দুই চোখ দিয়ে যেন অগ্নিবর্ষণ করতে লাগলেন। ভয়ঙ্কর ক্রোধে গৌরীর মধ্যে থেকেই বেরিয়ে এলেন চামুণ্ডা।
সেই দেবী কেবল কৃষ্ণবর্ণা তাই নয়, তিনি ভয়ঙ্কর মহা রৌদ্রবিনাশিনী। তাঁর অস্থিচর্মসারদেহ, করাল বদন, ঘোর বর্ণ, গলায় মুণ্ডমালা। দুর্গা মায়ের মতো অপূর্ব আঁখিপল্লব তাঁর নয়। কোটরাগত, রক্তাভ, ঘুর্ণায়মান চোখজোড়া যেন সাবধান করছে। তাঁর হাতে ভীষণ খড়গ। তাঁর হাসিতে চমকে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সমগ্র পৃথিবী।
অসুরেরা ভয়ে স্থানুবৎ হয়ে রইল। দেবী ছুটে এসে একের পর এক অসুরকে বধ করতে লাগলেন। সেই বিশাল হস্তী ও অশ্ব বাহিনীকে তিনি নিমেষে মুখে পুরলেন। সকল অস্ত্র তাঁর লোল, বিকট চর্মে লেগে টুকরো হয়ে গেল।
খড়গ দিয়ে প্রথমে চণ্ড ও পরে মুণ্ডের মুণ্ড ছিন্ন করে তবে থামলেন দেবী। আর এখানেই পুরাণে ঢুকে পড়ছে লোককথা। বলা হচ্ছে মুণ্ড তার ভাই চণ্ডের মৃত্যুর পরে ভয় পেয়ে শোন নদীর অববাহিকায় এক পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে। দেবী সেই স্থানে গিয়ে তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন। সেই স্থান সে দিন থেকে মাতা মুণ্ডেশ্বরীর স্থান নামে পরিচিতি লাভ করে।
দেবী মুণ্ডেশ্বরীর মন্দির ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন দুর্গা মন্দিরগুলির অন্যতম। দেবী এখানে মহিষারূঢ়া, প্রাচীন শিলামূর্তি। আনুমানিক আড়াইশো বছর পূর্বে এই নিষিদ্ধ পর্বতে কয়েক জন মেষপালক প্রথমে মন্দিরটি আবিষ্কার করেন। মন্দির নয়, তার ধ্বংসাবশেষ।
সে সময়ে ব্রিটিশ যুগ। প্রখ্যাত ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল সেই মন্দির পরিদর্শন করেন এবং মন্দিরের প্রাচীনত্বের বিষয়টি নথিবদ্ধ করেন।
পাহাড়ের পথ দিয়ে মন্দিরে যেতে গেলে অসংখ্য শিলালিপি পাওয়া যায়।
তার মধ্যে একটি বলছে, রাজা উদয় সেন ৩০ অব্দের কার্তিকের বাইশ তারিখ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই ত্রিশ অব্দটি শকাব্দ ধরে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১০৮ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ প্রায় ১৯০০ বছর আগের কথা। এই কথাকে সমর্থন করছে পরবর্তীতে পাওয়া ব্রাহ্মী লিপি। সেখানে সিংহলের রাজা দত্তগামিনী (১০১-১৭৭ সাল) খোদাই করছেন যে, তাঁর দেশ থেকে মানুষ পুজো দিতে এই মন্দিরে আসত।
এর পরে ভারতবর্ষ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি যিনি দিচ্ছেন, তিনি হিউয়েং সাং। তিনি এই মন্দিরের অস্তিত্ব স্বীকার করে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন– পটনা থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে দুশো লি ( ১ লি = ৫০০ মিটার) দূরত্বে পর্বতের শীর্ষে এক প্রাচীন মন্দিরের গায়ে রোদ ঝলকাচ্ছে। একেবারে এই দূরত্বেই কিন্তু দেবী মুণ্ডেশ্বরীর মন্দির!
এবং সবচেয়ে আশ্চর্য হল, এখানে শক্তিস্বরূপিনী দেবী মুণ্ডেশ্বরীর শিবলঙ্গটি প্রাচীন চতুর্মুখলিঙ্গম। রোদের বিভিন্ন সময়ের তারতম্যের সঙ্গে সেই লিঙ্গের রং পরিবর্তিত হয়। সম্ভবত এই কথাই হিউয়েন সাং তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করে গিয়েছেন।। তাই যদি হয়, তা হলেও তা রাজা হর্ষবর্ধনের আমল, অর্থাৎ ৬৩০ এর কথা। সেই হিসেবেও এই মন্দির আনুমানিক ১৪০০ বছরের পুরনো।
মন্দিরের পথে অসংখ্য প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। বয়সের নিরিখে যে মুদ্রাগুলি গুপ্তোত্তর যুগের বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আধুনিক শ্রীযন্ত্রমের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত প্রচুর জ্যামিতিক আকার খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন শিলাগুলির গায়ে। তার অধিকাংশই অস্পষ্ট ক্ষয়প্রাপ্ত, তাই অনুমান করা যায় না। শুধু তাই নয়, মায়ের এই অষ্টভুজাকৃতি মন্দিরটিও এমন ভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে যে, দেখে মনে হয় কেউ যেন ধারালো তলোয়ার দিয়ে নিপুণ ভাবে চেঁছে দিয়েছে মন্দিরটিকে।
এই সব কিছু থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই মন্দির বা পীঠটি সুপ্রাচীন কাল থেকে সাধনা ও তান্ত্রিক আচারের কেন্দ্রস্থল ছিল। তাই ১৯১৫ সাল থেকেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এই মন্দিরের দায়িত্ব নিয়েছে।
শিবরাত্রি, দুর্গাপুজোয় এখানে দেবীর আরাধনা এবং বিশাল মেলা হয়।
আর অলৌকিকত্ব! যুগযুগ ধরে বহু মানুষ এখানে সাক্ষী হয়ে রয়েছেন এক অদ্ভুত অলৌকিক ঘটনার। দেবী দুর্গা তথা মুণ্ডেশ্বরীর জন্য উৎসর্গীকৃত ছাগ এখানে বলি দেওয়া হয় না। দেবীর সম্মুখে এনে মন্ত্রপূত শস্য ছড়িয়ে ধারালো কুশঘাস দিয়ে তাকে স্পর্শ করা হয়। ছাগলটি ছটফট করতে করতে নেতিয়ে জড় ও মৃতবৎ হয়ে পড়ে। খানিক ক্ষণ পরেই আবার লাফিয়ে ওঠে। যেন মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এল।
এই মন্দির সেই সকল প্রাচীন প্রশ্নের উত্তর— যেখানে বলা হয় দেবী দুর্গার প্রাচীন মূর্তি নেই, ভাবনা নেই। দেবী দুর্গা যেন মুণ্ডেশ্বরী রূপে সকল প্রাচীন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়েছেন।