কলকাতা আর কালীর সম্পর্ক দীর্ঘকালের। আবহমানকাল থেকে কলকাতা কালীক্ষেত্র। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কালী মন্দির। সেকালের কলকাতায় কালী সাধনার অন্যতম পীঠস্থান ছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। যদিও নাম তখন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ছিল না। কলকাতাও নগরের রূপ পায়নি।
আজ যেখানে এসপ্ল্যানেড, স্ট্র্যান্ড রোড, তখন সেখানে বয়ে যেত পতিতপাবনী গঙ্গা। নদী তীরবর্তী এলাকায় ছিল শ্মশান। সেখানে বসে দেবী কালিকার সাধনা করতেন তান্ত্রিক, কাপালিকেরা। শব সাধনা থেকে নরবলি, কী না দেখেছে কলকাতা!
কাপালিকদের দাপট এক সময়ে এমন বেড়েছিল যে, সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখনই আসরে নামেন গৌড়রাজের সেনাপতি নরসিংহ।
প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগের কথা। সাধনায় সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে কোনও এক তান্ত্রিক দেবী চামুণ্ডার কাছে এক নাবালককে বলি দেন। খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসেন ছেলেটির বিধবা মা পদ্মা। এসে দেখেন, সব শেষ। যুবতী বিধবার একমাত্র সন্তানের প্রাণহীন দেহ পড়ে রয়েছে। তার পাশে বিজয়োল্লাস চলছে তান্ত্রিকদের।
নিজের কপালকে দুষতে শুরু করেন মা। দেবীর কাছে মাথা ঠুকতে ঠুকতে অজ্ঞান হয়ে যান সেই যুবতী। জ্ঞান ফিরতেই দেখলেন কামুক দৃষ্টিতে এক তান্ত্রিক তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। সন্তানহারা মা বুঝলেন এই সুযোগ, বদলা নিতে হবে। ছলনার আশ্রয় নিলেন। প্রেমের জালে তান্ত্রিককে ফাঁসিয়ে ডেরা থেকে বার করলেন।
তান্ত্রিকের চোখে তখন প্রেম আর কামনার আগুন। আগুনের দিকে যেমন পতঙ্গ এগিয়ে যায়, ওই তান্ত্রিকও এগিয়ে গেলেন। সন্তানহারা অসহায় বিধবা যে ফাঁদ পাতবেন, তা আর কে ভাবে!
পদ্মা সেই তান্ত্রিককে নিয়ে গিয়ে ফেললেন গৌড়াধিপতির নাগালে। বললেন সব ঘটনা। তান্ত্রিককে বন্দি করলেন গৌড়াধিপতি। সেনানায়কে হুকুম দিলেন, ‘যাও, কাপালিকদের উচিত শিক্ষা দাও’। খবর রটে গেল কলকাতায়। তান্ত্রিক, কাপালিকেরা আর কোনও রকম ঝুঁকি নিলেন না। চামুণ্ডার মূর্তি নিয়ে এলাকা ছাড়লেন।
গৌড়রাজের সেনাপতি নরসিংহ সেখানে একখানা সেনাছাউনি তৈরি করে ফিরে গেলেন। কিছু সেনাও থেকে গেল। তারাই আস্তে আস্তে বসতি গড়ল। কৃষিজীবী মুসলমানরা সেখানে এসে ভিড় বাড়াল। ভিড় জমালেই তো হল না। পেট চালাতে হবে। কাজ করে উপার্জন করতে হবে। জীবিকার প্রয়োজনে গড়ে উঠল কসাইখানা। মানুষ কসাইয়ের পেশা গ্রহণ করল।
সমজাতীয় পেশায় নিযুক্ত মানুষের পাড়াকে টোলা নাম দিয়ে এসেছে কলকাতা। কলুটোলা, ব্যাপারিটোলার মতো কসাইদের পাড়া হয়ে উঠল কসাইটোলা।
সেই কসাইটোলা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়েছে দু’শো বছর আগে। ১৮৩৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক মারা যান। তার পরপরই তাঁর নামে রাস্তা পায় মহানগর। কিন্তু এলাকা পত্তনের নেপথ্যে রয়েছে কালী আরাধনার ইতিহাস। তবে আজকের মহানগরে আর সে ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।