প্রতীকী চিত্র
সে বুঝলেন এক সময়ের কথা, মা পার্বতী এক দিন মস্ত অভিমানী হয়ে বসে রয়েছেন কৈলাসে। শিব ঠাকুর কিছুতে ভেবে না পান তাঁর এমন অভিমানের কারণ কী। শেষমেষ মর্ত্যে তাকিয়ে দেখতে পান, চতুর্দিকে ষষ্ঠী ব্রত পালিত হচ্ছে। শাঁখে ফুঁ পড়ছে।
অনেক সাধ্যসাধনার পরে দেবী বলেন, সবাই তাঁর নাম নিয়ে ষষ্ঠীব্রত পালন করছে। অথচ তাঁর কোলের কাছে তাঁর সন্তানটিই নেই। শিব ঠাকুর বলেন, এ আবার কোন কথা হল? বলে তিনি চললেন চন্দ্রলোক থেকে কার্তিক ঠাকুরকে আনতে। কার্তিক ঠাকুর তখন চন্দ্রলোকে থাকতে গিয়েছিলেন। মায়ের মন তাই ষষ্ঠী-দিনে বড়ই উচাটন।
**********
মা স্নানে গেলেন। সন্তান এত দিন পর ফিরবে, তাকে নিয়ে ঘুরবেন। তাই তাড়াতাড়ি স্নান-টান সেরে নিতে গেলেন। মায়ের দুই সখি মায়ের পাশে বসে তাঁর অঙ্গ মার্জনা করছেন, চন্দন আর হলুদের প্রলেপ মাখাচ্ছেন, উঠে আসছে ময়। মা গৌরীর ময় সাক্ষাৎ শক্তির অংশ।
তাই দুই সখী সেই দিয়ে আপন মনে পুতুল গড়তে বসেন। তৈরি হয় অপূর্ব দিব্যকান্তি এক পুতুল। সেই পুতুল দেখে নারায়ণের বড় লোভ হয়। আপন দিব্যাংশ সেই পুতুলের ভিতরে প্রবেশ করান তিনি। পুতুল প্রাণ পেয়ে অনিন্দ্যকান্তি পুত্র হয়ে লাফিয়ে পার্বতী মায়ের কোলে ওঠে।
এমন সময়ে কার্তিককে নিয়ে মহাদেবও পৌঁছলেন। দুই সন্তানকে কোলে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না মায়ের। সমগ্র দেবলোক অভিনন্দন জানাতে, উৎসবে শরিক হতে চলে এল কৈলাসে। এমন সময়ে মহাদেব লক্ষ্য করলেন, তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ভক্ত গ্রহরাজ শনিদেব আসেননি। ব্যাপার কী? ডাক পড়ল তাঁর। কিন্তু তিনিই বা কী করেন? তাঁর, অর্থাৎ শনিদেবের যে বক্র দৃষ্টির বর রয়েছে। সোজাসুজি তিনি কারও দিকে তাকাতে পারেন না। এমন অনিন্দ্যকান্তি পুত্রকে দেখতে আসাই তো উদ্দেশ্য। এসে যদি দেখতে না পারেন তা হলে কি হয়?
শনিদেব এলেন। কিন্তু এসে নিজের চোখ ঢেকে রাখলেন। মা পার্বতী পীড়াপীড়ি করেন, কেন তুমি সন্তানদের দেখবে না! এ দিকে শ্রী শনিদেবের মধ্যেও দুই ফুটফুটে সন্তানকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়। হাত সরিয়ে তিনি তাকালেন সদ্যোজাত পুত্রটির দিকে। আর ওমনি সেই শিশুপুত্রের ধড় থেকে শির আলাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মা পার্বতী মূর্ছা গেলেন। হাহাকার করে উঠল দেবকুল।
পুত্রশোকে কাতর মহাদেব নন্দী মহারাজকে বললেন, “যাও, উত্তর অর্থাৎ কৈলাস দিকে মাথা করে কেউ যদি শুয়ে থাকে, তার মস্তকটিই কেটে নিয়ে এস। আমি প্রতিস্থাপন করব পুত্রের শির।” নন্দী মহারাজ ঘুরতে লাগলেন। কেউ নেই এমন। শেষে দেখলেন, এক হস্তি উত্তর দিকে মাথা করে শুয়ে রয়েছে। সকল কথা খুলে বললেন তাকে। হস্তি স্বেচ্ছায় প্রাণ দিলেন। সেই শির নিয়ে এলেন নন্দী মহারাজ।
হস্তির শির নিয়ে প্রাণ ফিরে পেলেন গণেশ। মায়ের তবু মন ভরে না। অমন সুন্দর সন্তান ছিল তাঁর, এ কেমন দেখতে হয়ে গেল! তাঁর সন্তানের জন্য এক হস্তিও তো প্রাণ দিল। মায়ের চিরন্তন মন কেঁদে ওঠে।
হস্তির সেই মহান ত্যাগ ও গণেশ দেবকে চিরন্তন করার উদ্দেশ্যে দেবতারা ঘোষণা করলেন সকল পূজার পূর্বে তাঁর পূজা হবে। তিনি হবেন গণের অধিকারী শ্রী গণপতি।
**********
দেখতে দেখতে আশ্বিন মাস এসে পড়ল। মা পার্বতী সপুত্র বাপের বাড়ি মানে গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে এলেন।
মা মেনকা তো নাতিদের দেখে আহ্লাদে আটখানা। বেলতলা থেকে কোলে চাপিয়ে নিয়ে এলেন নাতিদের।
মা পার্বতী, মেনকা মায়ের কাছে সকল কথা খুলে বললেন। সেই ষষ্ঠীর দিনে মা মেনকা ভক্তিভরে, মা ষষ্ঠী স্বরূপা দুর্গাকে প্রণাম করে নাতিদের মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যে ব্রত করতে বসলেন। মেয়ে আসবে বলে সকাল সকাল তিনি না খেয়েই ছিলেন। অতএব উপোস রেখে ফুল, দূর্বা, ধূপ, দীপ, আতপ চালের নৈবেদ্য, ফল, মিষ্টান্ন দিয়ে পূজা সারলেন। ভক্তিভরে রচনা করলেন ষষ্ঠী ব্রত।
সেই থেকে দুর্গা ষষ্ঠীর দিনে যারা মায়ের ব্রত করে, ভক্তি করে মায়ের নাম নেয়, তাদের স-সন্তান সংসার সুখের হয়।
দুর্গাষষ্ঠীর দিনে ব্রতীদের অন্ন গ্রহণ করার নিয়ম নেই। ষষ্ঠী পূজা সমাপনে উপোস ভেঙে উপোসের প্রসাদ ও রাতে ফলমূল ও অন্যান্য খাবার খাওয়াই শ্রেয়।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।