ভূতের এত বাহার কেবল বঙ্গদেশেই সম্ভব। পরশুরামের লেখা ‘ভূষণ্ডীর মাঠে’-তে দেখা মিলেছিল হরেক রকম ভূতের। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের দৌলতে ছোটবেলাতেই বঙ্গসন্তানদের সঙ্গে ভূতেদের দোস্তি গড়ে ওঠে। সিনেমায় বাঙালি ভূতকে রাজা হিসাবে দেখেছে যেমন, আবার ভূতেদের বাসস্থানের সমস্যাও উঠে এসেছে পর্দায়। খাঁটি বাঙালি ভূতেরা, যাঁরা বইয়ের পাতায়, গ্রাম-বাংলার লোককাহিনিতে আজও বিরাজ করেন, তাঁদের চেনেন?
চিনে নিন তেনাদের ব্রহ্মদৈত্য: ব্রাহ্মণেরা নাকি মৃত্যুর পর ব্রহ্মদৈত্য হন। এরা ভূতকুলে কুলীন। খাটো ধুতি পরা, গায়ে পৈতে ঝোলানো শান্ত, নিরীহ বামুন ভূত। এঁরা বেলগাছে থাকতে ভালবাসেন।
মামদো: মুসলমানরা মারা গেলে নাকি মামদো ভূত হন। এঁদের মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান, লম্বা দাড়ি আর মাথায় থাকে ফেজ টুপি। পা নেই, ভেসে বেড়ান। কবরস্থানের পাশে দেখা দেন এঁরা।
পেত্নী: শ্যাওড়া গাছ থেকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারে পেত্নীরা। পায়ের পাতা উল্টো দিকে ঘোরানো। আইবুড়ো মহিলারা অপূর্ণ ইচ্ছে-আকাঙ্খা নিয়ে মারা গেলে পেত্নী হয়। এরা খুব লোভী, খাবার চেয়ে-চিন্তে খায়। গভীর রাতে এদের সামনে দিয়ে মাছ নিয়ে আসা-যাওয়া করা যায় না।
ঝেঁয়ো পেত্নী: এরা নাকি ঝাউগাছে লুকিয়ে থাকে। ভরসন্ধ্যায় কেউ যদি একা একা ঝাউ বন বা জঙ্গল পেরোতে যায়, তখন তাকে ধরে মগডালে নিয়ে যায়।
শাঁকচুন্নি: বিবাহিতা মহিলারা নাকি মৃত্যুর পরে শাঁকচুন্নি হয়ে যান। লাল শাড়ি, পায়ে আলতা, হাতে শাঁখা-পলা, সধবার বেশে থাকেন এঁরা। সধবা মহিলাদের ‘টার্গেট’ করেন এঁরা। এই শাঁকচুন্নি বেশ ঝগড়ুটে ভূত।
কুনি-বুনি: কুনি-বুনি দু’জনেই পেত্নী। ঘরের কোণে নোংরা-আবর্জনার মধ্যে থাকে কুনি। বাঁশ বনে থাকে বুনি।
গেছো ভূত: এই ভূতের বাস গাছে। শোনা যায়, গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে গেছো ভূত হয়। রাতে গাছের তলা দিয়ে কেউ গেলে এরা ভয় দেখায়। তাল গাছ এদের প্রিয় বাসস্থান। আবার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে গলাসি ভূতও হয়। গলায় দড়িতে জড়িয়ে কোনও গরুর মৃত্যু হলে গোভূত হয়। স্কন্ধকাটার মতো এদেরও মাথা থাকে না।
মেছো ভূত: এরা মাছপ্রেমী। নদী-পুকুর-জলাশয়ের আশপাশের গাছেই নাকি বসবাস। মাছের লোভে এরা সব কিছু করতে পারে। গৃহস্থের রান্নাঘর, জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খায় এরা।
চোরাচুন্নি: চোর মারা গিয়ে নাকি চোরাচুন্নি হয়। চুরির অভ্যেস পরকালেও ছাড়তে পারে না এরা।
স্কন্ধকাটা: এদের মাথা নেই। মুণ্ড-কাটা দেহ নিয়ে হারানো মাথা খুঁজতে বেরোয়। মানুষ মেরে তাদেরকে নিজেদের দাসে পরিণত করা স্বভাব স্কন্ধকাটাদের।
কানাভুলো: ভুলিয়ে অচেনা জায়গায় নিয়ে গিয়ে কাজ হাসিল করে কানাভুলোরা। এরা ভ্রম তৈরি করতে ওস্তাদ। এই ভূতেরা নাকি দলছুট বা একা মানুষকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে শিকার করে। এদের খপ্পরে পড়লে বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে মানুষ। তখনই ঘাড় মটকে দেয় কানাভুলো। মাঠের ধারে বা নির্জন পথের মধ্যে এই ভূত দেখা যায়।
একানড়ে: ‘চন্দ্রবিন্দু’-র গানটা মনে আছে? ‘আমার ঘাড়ে একানড়ে ঠ্যাং ঝুলিয়ে নাচে...’। সেই একানড়ে একটি মাত্র পা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিশালাকার দাঁত নিয়ে এরা তালগাছের মগডালে বসে থাকে। পথচারীদের লম্বা ঠ্যাং ঝুলিয়ে ভয় দেখায়।
জটাধারী: বসবাস জলের তলায়। সাঁতার কাটার সময়ে নাকি মানুষদের পা জড়িয়ে ধরে জলে ডুবিয়ে মারে জটাধারী।
দেও: এরা পুকুর-ডোবা, নদী এবং বিভিন্ন জলাশয়ে বসবাস করে। লোকজনকে জলে ফেলে ডুবিয়ে মারে। পুকুর, ডোবা, নদী বা জলাশয়ে আরও এক ধরনের ভূত থাকে, নাম জোকা ভূত।
বেঘো: বাঘের আক্রমণে মৃতরা বেঘো ভূতে পরিণত হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে নাকি এই ভূতের আধিক্য বেশি। জঙ্গলে মধু আনতে বা কোনও কাজে বনে যাওয়া মানুষদের এরা ভয় দেখিয়ে বাঘের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
নিশি: পল্লীবাংলার বিখ্যাত ভূত নিশি। নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে ফেললেই খেল খতম্! গভীর রাতে কেউ নাম ধরে ডাকলে সাবধান! অন্তত ৩ বার না-ডাকলে ভুলেও সাড়া দেওয়া নেই। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)