—প্রতীকী ছবি।
পুজোর মণ্ডপে মণ্ডপে তাঁরা কার্যত অনাহূত। ঠাট্টা, টিটকিরি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, ভ্রু কুঞ্চন— উৎসবের দিনগুলিতে সমাজের থেকে তাঁদের প্রাপ্তি বলতে এটুকুই। কিন্তু এ বারের পুজোটা কিছুটা আলাদা হতে চলেছে সমাজের এই প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য। কারণ, এই পুজোতেই প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসছেন শহরের রূপান্তরকামী ও সোনাগাছির যৌনকর্মীরা। পুজোর ‘মুখ’ থেকে শ্রেষ্ঠ পুজোর বিচারক— মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে সব ক্ষেত্রেই এক্কেবারে সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের।
নিজের ‘আসল’ পরিচয় সামনে আসার পরে সোনারপুরের পাড়ার পুজোয় এক প্রকার একঘরে হয়ে পড়েছিলেন মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। রূপান্তরকামী আইনজীবী সায়ন্তনের কাছে সেই দিনগুলির স্মৃতি বড়ই করুণ। কিন্তু এ বার গল্পটা বদলেছে। সায়ন্তনের কথায়, ‘‘যে পুজোয় এক দিন ব্রাত্য ছিলাম, আজ আমি সেখানকারই পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।’’
শহরের ফ্যাশন ডিজ়াইনার ইরানি মিত্রের প্রাক-পুজো ফ্যাশন শোয়ের মূল আকর্ষণ হিসেবে র্যাম্পে হাঁটতে চলেছেন তৃতীয় লিঙ্গের এই প্রতিনিধি। দুর্গা থিমের এই ফ্যাশন শোয়ে সায়ন্তনের দুর্গা-রূপ দেখবেন অতিথিরা। ‘শো স্টপার’ হিসেবে এক জন রূপান্তরকামীই কেন? ইরানি বলছেন, ‘‘নারী ও পুরুষের মিলিত সত্ত্বা দুর্গার ত্রিনয়নের একটি অংশ। তাই সায়ন্তনের সঙ্গে আলাপের পরে মনে হয়েছিল, এই ফ্যাশন শোয়ের মুখ হতে পারেন একমাত্র তিনিই।’’
আরও পড়ুন: পুজোয় জাগে মানকর
আরও পড়ুন: ৪০ ফুটের বড় দুর্গা এ বার পাঁশকুড়ার পুজোয়
একদা পুজোয় অচ্ছুত এই রূপান্তরকামী ও যৌনকর্মীদের উপরে এ বার ভার শহরের শ্রেষ্ঠ পুজো বেছে নেওয়ার। একটি শারদ সম্মানের বিচারক মণ্ডলীতে সসম্মানে থাকছেন রূপান্তরকামীদের তিন প্রতিনিধি— সায়ন্তন, লোক আদালতের বিচারক জয়িতা মণ্ডল এবং কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। থাকছেন সোনাগাছির বেশ কয়েক জন যৌনকর্মীও। আয়োজকদের তরফে রাজর্ষী দাস বলছেন, ‘‘স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ২৬ জন নারীকে বিচারক হিসেবে বেছে নিয়েছি। তাঁদের মধ্যে রূপান্তরকামীরাও পড়েন। আর সমাজের জন্য যৌনকর্মীদের কাজ প্রশংসার দাবি রাখে।
তাই এই উদ্যোগে শামিল তাঁরাও।’’
পুজোয় নিজেদের নতুন ভূমিকায় বেশ উচ্ছ্বসিত সোনাগাছির ‘উমা’রা। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দুর্বার’-এর সচিব ও যৌনকর্মী কাজল বসু বলছেন, ‘‘পুজোয় পুরস্কার দেব ভেবেই ভাল লাগছে। দুর্বারের তরফ থেকে আলাদা করে পুরস্কার দেওয়ার কথাও আয়োজকদের জানিয়েছি।’’ আর সংগঠনের কর্ণধার স্মরজিৎ জানা বলছেন, ‘‘পুজোটা ওঁদের কাছে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই লড়াইয়ের জোরেই এ বার যৌনকর্মীরা সামনে আসছেন।’’
তবে কি বদলাচ্ছে শহর কলকাতা? অতীত স্মৃতি ভুলে ধীরে ধীরে এই প্রান্তবাসীদের ‘আপন’ করে নিচ্ছেন শহরবাসী? সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্রের ব্যাখ্যা, ‘‘এ ভাবেই আস্তে আস্তে সমাজে এঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। পুজোপার্বণে এঁদের এ ভাবে তুলে ধরা আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ হলেও এক সময়ে তা স্বাভাবিকতায় পৌঁছবে। যাঁরা এ ভাবে ভাবতে শুরু করেছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাচ্ছি।’’ এলজিবিটি মানুষদের জন্য কাজ করা সমাজকর্মী সুমিতা বীথির অবশ্য মত, ‘‘৩৭৭ ধারা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় হয়তো অনুঘটকের কাজ করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে শীর্ষ আদালতের রায়ের পরেও এই উদ্যাপন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি।’’
মানসিকতার পরিবর্তন যে এত সহজে আসবে না, তা অবশ্য বিলক্ষণ জানেন জয়িতা-সায়ন্তন-কাজলেরা। ‘নতুন রায়ে আমাদের বেশ অসুবিধা হল দেখছি!’ —অ্যাপ-ক্যাবে উঠে অল্পবয়সীদের এমন টিপ্পনী এখনও শুনতে পান রূপান্তরকামী যাত্রী। তাই তো আইনজীবী সায়ন্তন বলেন, ‘‘পুজোয় আমাদের নিয়ে মাতামাতি হল আর তার পরে লোকে ভুলে গেল, সেটা কাম্য নয়। পুজোর গণ্ডী ছাড়িয়ে বাকি সময়েও যেন আমাদের এ ভাবেই আপন করে নেওয়া হয়।’’
এ বারের পুজোয় তাই তাঁদের একটাই প্রার্থনা— ‘সহানুভূতি নয়, সমানুভূতি চাই’।