সোমবার আমেরিকার এক প্রভাবশালি নেতার ঢাকায় ঝটিকা সফরকে ঘিরে নানা রকম গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে। সাধারণের মধ্যে রিভিউ রায় নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তা ছিল, তেমনি উদ্বিগ্ন ছিলেন স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। মাহবুবে আলম সোমবার এক বিবৃতিতে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েও ছিলেন। আজ, মঙ্গলবার রায় শোনানোর দিনে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের আইনজীবীদের আদলত প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকারও ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু সব আশঙ্কা উড়িয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আলবদর কমান্ডার মির কাসেম আলির রিভিউ আবেদন খারিজ করে প্রাণদণ্ডের সাজা-ই বহাল রেখেছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার সকালে ৯টা ১ মিনিটে মির কাসেমের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার চূড়ান্ত ধাপে এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকি, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মহম্মদ বজলুর রহমান।
মির কাসেম আলি হচ্ছেন বর্তমান জামাতে ইসলামির প্রভাবশালি নেতা এবং দলের অর্থ ভাণ্ডারের প্রধান নিয়ন্ত্রক। সামান্য ছাপোষা এক টেলি যোগাযোগ কর্মচারীর ঘরে জন্ম নেওয়া এই মির কাসেম আলি ১৯৭১ সালে ছিলেন জামাতের ছাত্র শাখার চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী মানুষের কাছে মির কাসেমের পরিচিতি ছিল জল্লাদ হিসেবে। ধনকুবের মির কাসেম মানবতা বিরোধী মামলা থেকে রেহাই পেতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন পশ্চিমা দুনিয়ায় লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে। তাঁর নিজের আইনজীবীরাই এ সব তথ্য অকপটে স্বীকার করেছেন মামলার চুড়ান্ত পর্বে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর প্রাথমিক পর্বেই এই বিচার নস্যাৎ করতে দেশি বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করেন মির কাসেম। বিচার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামে একটি ল-ফার্মের সঙ্গে প্রায় পৌনে ৩০০ কোটি টাকার চুক্তির অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
মানবতাবিরোধী অপরাধী মির কাসেম আলিকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখেই চলতি বছরের ৮ মার্চ সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। গত ৬ জুন এই যুদ্ধাপরাধীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৯ জুন রিভিউ আবেদন করেন মির কাসেম।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে এই মানবতাবিরোধী অপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারবেন আর রাষ্ট্রপতি ক্ষমা না করলে সরকার যে কোনও দিন তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে। রিভিউ রায়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তা ছাড়া, আওয়ামি লিগ-সহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও জোট এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রাণদণ্ডের সাজার দাবিতে সোচ্চার গণজাগরণ মঞ্চও মির কাসেমের প্রাণদণ্ডের সাজা বহাল থাকায় উল্লাস মিছিল বের করেছে ঢাকায়।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, নির্যাতন, গুম ও অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন-সহ ১৪টি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মির কাসেম আলির বিচার হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল ১০টি অপরাধের মধ্যে দু'টির জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয় তাঁকে। বাকি আটটি অপরাধে মোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। পরে আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের দুটির বদলে একটি অপরাধের জন্য ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকে।
স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যে কজন বাঙালি দোসর সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন, তাদের অন্যতম হলেন মির কাসেম আলি। শুধু পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাই করেননি, নিজের হাতেও চালিয়েছেন নির্যাতন, করেছেন হত্যা। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ডালিম হোটেলে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হত। এঁদের অনেককেই হত্যা করা হয়।
আজ সকালে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মির কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়ার আট ঘন্টার মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। ২৯ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশের পরে পরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে পৌঁছে গেছে।
এই রায়ের কপি কারাগারে পাঠানো হবে। যুদ্ধাপরাধী মির কাশেমকে পড়ে শুনিয়ে জানা হবে- তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না!
পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম আনন্দবাজারকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী মির কাশেম আলির বিষয়ে সব রকম আইনের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। এখন তাঁর সামনে একটাই পথ আছে, রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। সেই জন্য সাত দিন সময় পাবেন এই যুদ্ধাপরাধী। সাতদিনের মধ্যে প্রাণভিক্ষা না চাইলে মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নে আর কোনও বাধা থাকবে না।
আরও পড়ুন: বিচার নস্যাৎ করতে লবিস্ট নিয়োগ করেন মির কাসেম