Bangladesh News International Mother Language Day

ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জী

ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত লেখক, সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের সংগঠন ‘তামুদ্দুন মজলিস’ ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান: বেঙ্গলি অর উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকাতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ঢাকা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৪
Share:

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩। আবুল বরকতের মরদেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাঁর মা-বাবা।

আন্দোলনের প্রথম পর্যায়

Advertisement

১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭: ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত লেখক, সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের সংগঠন ‘তামুদ্দুন মজলিস’ ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান: বেঙ্গলি অর উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকাতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে। মজলিসের সেক্রেটারি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে প্রথম একটি আলোচনাসভা ডাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে।

নভেম্বর, ১৯৪৭: করাচিতে বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের ডাকা পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গণ্য করার বিরোধিতা করলেন।

Advertisement

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮: পাকিস্তান এসেম্বলিতে বিরোধী সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব আনেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি এবং অন্যান্য অবাঙালি সদস্যরা প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। দুঃখজনক ভাবে, দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে আসা সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও কয়েক জন বাঙালি সদস্যও এর বিরোধিতা করেন। পরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাবটির কয়েকটি সংশোধনী আনলেও প্রত্যেক বারই পশ্চিম পাকিস্তানিরা এবং তাদের অনুগত কয়েক জন বাঙালি সদস্য বিরোধিতা করতে থাকেন। সংখ্যাগুরু বাঙালিদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা অনড় ছিলেন।

বাঙালি আমলা, শিক্ষাবিদ, ছাত্র এবং মধ্যবিত্তদের অন্যান্য অংশের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার দাবি শক্তিশালী হয়ে উঠল। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিতর্ক রাস্তায় নেমে আসে। বলা হয়, মন্ত্রী-সহ প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির বেশ কিছু সদস্যও সক্রিয় ভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্ট লিগ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সভা।

মার্চ, ১৯৪৮ (প্রথম সপ্তাহ): বাম, দক্ষিণ ও মধ্যপন্থী— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব রাজনৈতিক মতাবলম্বী ছাত্ররা মিলে বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করলেন।

১১ মার্চ, ১৯৪৮: বাংলাকে জাতীয় ভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ, ঢাকার বহু ছাত্র গ্রেফতার। পরের দিনগুলিতে পরিস্থিতির আরও অবনতি। ১৯ মার্চ থেকে কায়েদ-এ-আজমের ঢাকা সফরের কথা ছিল। ব্যাপক বিক্ষোভের চাপে গভর্নর জেনারেলের আসন্ন সফরের অপেক্ষায় থাকা বিচলিত নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক সরকার অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য মুহম্মদ আলি বোগরার সাহায্য প্রার্থনা করল। নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে কমিটির এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে, (১) পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে এবং সর্ব স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা করতে প্রাদেশিক সরকার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবে এবং (২) অ্যাসেম্বলিতে আর একটি প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলাকে জাতীয় ভাষা করার জন্য সুপারিশ করা হবে।

২১ মার্চ, ১৯৪৮: পাকিস্তানের স্রষ্টা এবং প্রথম গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না পূর্ব বাংলা সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, “বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, কিন্তু উর্দু ছাড়া অন্য কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। যাঁরা আপনাদের বিপথে চালিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁরা পাকিস্তানের শত্রু।”

তাঁর এই মন্তব্যে অপমানিত বোধ করা বাঙ্গালি যুবসমাজ ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাল, কেননা তাদের যুক্তি, পাকিস্তানের জনসংখ্যার পঞ্চাশ ভাগ মানুষেরই মাতৃভাষা বাংলা। যাঁরা প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছিলেন এবং আটক হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সেই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই বাংলা ভাষার সমর্থনে সভাগুলি ডাকা হতে থাকল।

অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে জিন্না তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, কেবল একটিমাত্র ভাষাই জাতীয় ভাষা হতে পারে, কিন্তু ছাত্ররা তা মেনে নিলেন না।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়

২৬ জানুয়ারি, ১৯৫২: পাকিস্তান কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির বেসিক প্রিন্সিপল কমিটি সুপারিশ করল যে, একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হতে পারে। পল্টন ময়দানে এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন, একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হতে চলেছে। এই দু’টি ঘটনার পরেই পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় দফার ভাষা আন্দোলন শুরু হল।

২৮ জানুয়ারি, ১৯৫২: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিবাদসভায় ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রী এবং প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীদের পশ্চিম পাকিস্তানের তল্পিবাহক আখ্যা দিলেন।

৩০ জানুয়ারি, ১৯৫২: আওয়ামি লিগের ডাকা একটি গোপন বৈঠকে, যেখানে কম্যুনিস্ট জোট ছাড়াও অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই একমত হলেন যে, সার্থক ভাবে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যেতে হলে একা ছাত্ররাই যথেষ্ট নয়। সব স্তরের রাজনৈতিক এবং ছাত্র সমর্থন পেতে ঠিক হল, মৌলানা ভাসানির নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ এই আন্দোলন চালাবে।

৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২: ঢাকায় একটি সর্বদল বৈঠকে ভাসানি সভাপতিত্ব করলেন। আব্দুল হাশিম এবং হামিদুল হক চৌধুরীর মত বিশিষ্ট নেতারা এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কাজি গোলাম মাহ্‌বুবকে আহ্বায়ক করে এবং মৌলানা ভাসানিকে চেয়ারম্যান করে একটি সম্প্রসারিত ‘অল পার্টি কমিটি অব অ্যাকশন’ গঠন করা হল। কমিটিতে আওয়ামি লিগ, স্টুডেন্ট লিগ, ইয়ুথ লিগ, খিলাফতে রাব্বানি পার্টি এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি অব অ্যাকশন থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি নেওয়া হল।

২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। মেডিক্যাল হস্টেলের সামনে শোকমিছিল।

৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: পূর্ব বঙ্গ জুড়ে ‘ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের’ প্রতিবাদে কমিটি অব অ্যাকশন ঢাকায় একটি প্রতিবাদসভা ডাকে। আওয়ামি লিগের প্রাদেশিক প্রধান মৌলানা ভাসানি সেই সভায় ভাষণ দেন। আবুল হাশিমের পরামর্শক্রমে ঠিক হয়, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল অ্যাসেমব্লির বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন, একটি সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হবে।

২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: সন্ধ্যা ছ’টার সময় ঢাকা শহরে মিছিল এবং মিটিংয়ের উপর ১৪৪ ধারা অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি হল। এই আদেশ ছাত্রদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিল।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: সাধারণ ধর্মঘট পালিত হল।

দুপুর- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি সভায় ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন, নুরুল আমিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হবে। এবং সেই মতো প্রাদেশিক অ্যাসেমব্লির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে বেশ কয়েকটি মিছিল বের করা হয়। পুলিশ প্রথমে ছাত্রদের দিকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে এবং ছাত্ররাও পাথর ছুঁড়ে তার পাল্টা জবাব দেন। তার পর সংঘর্ষ আশপাশের মেডিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যাম্পাসেও ছড়িয়ে পড়ে।

বিকেল ৪টা

মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের সামনে পুলিশ গুলি চালায়। এতে পাঁচ জন— মহম্মদ সালাউদ্দিন, আব্দুল জব্বর, আবুল বরকত, রফিকুদ্দিন আহমেদ এবং আব্দুস সালাম নিহত হন। এঁদের মধ্যে প্রথম তিন জন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

এই হত্যার খবর সারা শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। এবং হাজারে হাজারে মানুষ মেডিক্যাল কলেজ চত্বরের দিকে ছুটে এলেন।

অ্যাসেমব্লির ভিতরে ছ’জন বিরোধী সদস্য সভা মুলতুবি রাখা এবং গুলিচালনার ঘটনার তদন্ত দাবি করলেন। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী সভা চালিয়ে যেতে বলেন। প্রতিবাদে, সমস্ত বিরোধী সদস্যরা ওয়াকআউট করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬। পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মরণে ‘শহিদ মিনার’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে মৌলানা আব্দুল খান ভাসানি।

২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: হাজার হাজার মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহতদের জন্য প্রার্থনা করতে জড়ো হলেন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে। প্রার্থনার পর তাঁরা যখন মিছিল করে যাচ্ছেন, তখন পুলিশ গুলি চালায়। ক্রুদ্ধ মানুষজন একটি সরকারপন্থী খবরের কাগজের অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। পুলিশ তাঁদের উপরেও গুলি চালায়। এই ঘটনায় চার জনের মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাওয়ায় তা সামলানোর জন্য সরকার মিলিটারি ডাকে।

চাপের মুখে নতিস্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা উচিত— এই মর্মে কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে একটি মোশন আনেন। মোশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। “এই প্রথম বহু মুসলমান ধর্মাবলম্বী সদস্য হিন্দু কংগ্রেস বিরোধীদের আনা সংশোধনীগুলির পক্ষে ভোট দেন। মুসলিম লিগে বিভাজন সম্পূর্ণ হল যখন তাদের কিছু সদস্য নিজেদের জন্য স্পিকারের কাছে পৃথক ব্লকের জন্য দাবি জানালেন। আওয়ামি (মুসলিম) লিগ বিরোধী দলের তকমা পেল।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: একটি সম্পূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ফের সরকার দমননীতি প্রয়োগ করে। এর প্রতিবাদে এ পি সি এ ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ ফের একটি সাধারণ ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। বরকতকে যেখানে গুলি করা হয় সেই যায়গায় মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা পুলিশের গুলিতে নিহতদের ‘চরম আত্মোত্সর্গ’ স্মরণে রাতারাতি ‘শহিদ মিনার’ গড়ে ফেললেন। পরে বাঙালিদের কাছে এই শহিদ মিনার হয়ে ওঠে ঐক্যের প্রতীক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন