আবৃত্তির ক্লাসরুম থেকে আজ আমরা একটু বাইরে বেরোই। যদিও আবৃত্তি বলতে আমরা মূলত কবিতা বা গদ্যের স্মৃতিনির্ভর উচ্চারণই বুঝি, কিন্তু তার বাইরেও এই শিল্পের কিছু বন্ধু পরিজনও আছে। আজ আমরা একটু তাদের কথা বলি। শ্রুতিনাটক, সংবাদপাঠ, সংযোজনা ইত্যাদি এমনই সব আঙ্গিক যারা আবৃত্তিশিল্পের সঙ্গে বেশ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে।
ছোটবেলায় রবিবার দুপুরে বা শুক্রবার সন্ধ্যায় রেডিয়ো নাটক শোনার একটা অদ্ভুত টান ছিল। শুনতাম কেমন করে অভিনেতারা গলায় নিয়ে আসছেন অনুভূতির নানা রং-রাগ, দুঃখ-অভিমান-বিষাদ, হতাশা, আনন্দ, সব কিছুকে নিয়ে আসছেন গলায়। আমার চোখের সামনে কোনও দৃশ্যমাধ্যম না থাকলেও আমি দেখতে পাচ্ছি পর পর ছবি। আমি দেখতে পাচ্ছি সব চরিত্রকে—তারা কেমন করে কথা বলছে, কেমন করে হাঁটছে—সব ভেসে উঠছে আমার চোখে। এটাই শ্রুতিনাটকের ম্যাজিক। শ্রুতিনাটক করার সময় শিল্পীকে সেই চরিত্রটা হয়ে উঠতে হবে। তার মানে কথাও বলতে হবে সেই চরিত্রের মতো করে। এ জন্য যাঁরা শ্রুতিনাটক করেন, তাঁদের বলব আশেপাশের মানুষজনদের খুব ভাল ভাবে লক্ষ করুন। কোনও পেশার মানুষ কেমন ভাবে কথা বলেন, একই পেশার বিভিন্ন মানুষ কেমন আচরণ করেন সেগুলো দেখুন। মানুষের কথা বলার ভঙ্গি দেখে তার চরিত্র কতটা বিশ্লেষণ করা যায় সেটাও দেখুন। তার পর সেগুলো যোগ করুন ঠিক জায়গায়। শ্রুতিনাটকে একদম পরিস্থিতির সঙ্গে এক হয়ে যেতে হবে। চরিত্রের প্রয়োজনে উচ্চারণকে বিকৃত করতেও হতে পারে। যাঁদের আঞ্চলিক টান আছে, তাঁরা শুদ্ধ বাংলায় বা বলা ভালো মান্য বাংলায় কথা বলুন। কিন্তু আঞ্চলিক টানটা একেবারে ভূলে যাবেন না। অনেক সময় সেটা খুব মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রুতিনাটকের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে সংবাদপাঠ। শ্রুতিনাটকে যেমন আবেগকে প্রকাশ করতেই হয়, আনন্দে হেসে ওঠারও সুযোগ আছে শ্রুতিনাটকে, সংবাদ পাঠ তেমনই আবেগহীন। এখানে খবর পৌঁছে দেওয়াটা সংবাদপাঠকের কাজ। এই খবর পৌঁছে দিতে হয় খুব নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। আবেগহীন উচ্চারণে। কোনও দুর্ঘটনার খবরে দুঃখপ্রকাশ বা প্রিয় দলের খেলায় জয়ের খবরে উচ্ছ্বাসের প্রকাশ —কোনওটারই অবকাশ সংবাদ পাঠে নেই। সংবাদপাঠক আবেগহীন বার্তাবাহক মাত্র। সঠিক উচ্চারণ, সঠিক যতি, কণ্ঠস্বরের সঠিক প্রয়োগ আর খুবই সীমিত আবেগ—এইটুকুই সংবাদপাঠের উপকরণ। কোনও নাটকীয় মুহূর্তকে মূর্ত করা নয়, কবির অনুভূতির বহিঃপ্রকাশও নয়, কিছু তথ্য অনর্গল ভাবে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়াই সংবাদপাঠকের কাজ।
সংবাদপাঠের সময় রিপোর্টাররাও অনেক সময় ঘটনাস্থল থেকে রিপোর্টিং করেন। ঘটনাস্থল থেকে রিপোর্টিংয়ের সময় দর্শক বা শ্রোতারা একটু বেশি তথ্য আশা করেন। যিনি এই তথ্য জোগাড় করতে পারবেন এবং সাবলীল ভাবে দর্শক বা শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন তিনি এই পেশায় তত বেশি সফল। রিপোর্টারেরা বাচিক শিল্পী নন। খবর যোগাড় করাটাই তাঁদের কাজ। কিন্তু যেহেতু মাঝে মাঝে তাঁদের সরাসরি খবর দিতেও হয়, তাই বাচিক শিল্পের গোড়ার কিছু কথা তাঁরা জেনে নিলে ভাল হয়। অনেক সময় তাঁরা উচ্চারণ নিয়ে যত্নবান হন না। কথা বলার সময়ও মাঝে মাঝে মনে হয়, আর একটু সাবলীলতা দরকার। এগুলো নিয়ে রিপোর্টারেরা আর একটু ভাবতে পারেন।
সংযোজনার কথায় আসি। সংযোজকের ইংরেজি শব্দটা বেশ সুন্দর—অ্যাংকর। মানে একজন সংযোজক অনুষ্ঠানকে শুধু সুন্দর করে সাজিয়েই দেন না। তাকে একেবারে মাটির সঙ্গে গেঁথে দেন। তাই একজন সংযোজকের দায়িত্ব অনেক। জড়তাহীন উচ্চারণ, কণ্ঠস্বরের সঠিক ব্যবহার এগুলো তো জানা চাই, তার সঙ্গে যেটা চাই সেটা হল তাঁর আন্তরিক বাচনভঙ্গি ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে দরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো উপস্থিত বুদ্ধি। আর যেটা দরকার সেটা হল কথা তৈরি করার ক্ষমতা। একজন আবৃত্তিকারকে কথা তৈরি করতে হয় না, কথা মনে রাখতে হয়। কিন্তু সংযোজককে কথাও তৈরি করতে হয়। এটা আবৃত্তির সঙ্গে সংযোজনার বড় একটা তফাত।
একজন সংযোজককে ভীষণ ভাবে ওয়াকিবহাল থাকতে হয় বিভিন্ন বিষয়ে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়েও সচেতন থাকতে হয়। সংযোজনার সময় এগুলো কাজে লাগানো যায়। এই প্রসঙ্গে দাদাঠাকুরের একটি গল্প মনে পড়ল। দাদাঠাকুরের আসল নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। কিন্তু তিনি দাদাঠাকুর নামেই পরিচিত। রেডিয়োতে ছোটদের বৈঠক আর পল্লীমঙ্গল আসর— এই দু’টি অনুষ্ঠান দাদাঠাকুর পরিচালনা করতেন। একদিন ছোটদের বৈঠকের শেষে দাদাঠাকুর তাঁর ভাষণ শেষ করে ফেলেছেন দু’মিনিট আগে। তার পরেই শুরু হবে সংবাদপাঠ। এ অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত কর্মী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী তখন স্টুডিয়োতে ছিলেন। তিনি দু’টি আঙুল তুলে দাদাঠাকুরকে ইশারা করলেন। দাদাঠাকুর মুহূর্তে ইঙ্গিতটি বুঝে নিয়ে ছোটদের বৈঠকের শ্রোতাদের উদ্দেশে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘‘তোমরা আমার কথা শুনলে তো? এই বারে আরম্ভ হবে নিউজ। নিউজ কথাটার একটা বিশেষ অর্থ আছে। এন, ই, ডব্লু, এস— কথাটার গোড়ায় ‘এন’ নর্থের সঙ্কেত, তেমনই ইস্ট-এর ‘ই’, ওয়েস্ট-এর ‘ডব্লু’, আর সাউথ-এর ‘এস’। অর্থাৎ উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ চতুর্দিকের খবর আসে বলে এর নাম নিউজ। এবার তোমরা নিউজ শোনো।’’ শ্রোতারা বুঝতেই পারল না আড়ালে কী কাণ্ডটা ঘটে গেল। এই উপস্থিত বুদ্ধি, রসবোধ, বুদ্ধিদীপ্ত কথা— এগুলোই সংযোজনাকে শিল্পের স্তরে নিয়ে যায়।
একটা ভাষা শুদ্ধ করে বলাটাও সংযোজনার একটা বড় দিক। বাংলাতে সংযোজনা করলে যত দূর সম্ভব বাংলা বলাই ভাল। সাইকেলকে দ্বিচক্রযান বা গামবুটকে আজানুপত্রচরণ বলার দরকার নেই। কিন্তু অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করাই ভাল। আগের কথাগুলোই আমি যদি এ ভাবে বলতাম, ‘‘আননেসেসারি ইংলিশ ওয়ার্ড ইউজ না করে বাংলাটাই বলো। আফটার অল অ্যাঙ্করিং তো ল্যাঙ্গোয়েজ স্কিল,’’ তা হলে কি শুনতে ভাল লাগত? আরও ভয়ঙ্কর বাংলা শোনা যায় মাঝে মাঝে। সে সব কথায় ওপর-চটক হয়তো আছে, কিন্তু শুদ্ধতার আত্মবিশ্বাস নেই। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের একটা কবিতার কিছু লাইন মনে এল এ প্রসঙ্গে। লাইনগুলো এ রকম—
তোমাকে যেই ফোনে ধরতে চাই
একই নারীস্বর
আমায় বলে: ‘ফিকর মত কিজিয়ে’
কৃপয়া রহিয়ে লাইন পর,
আপনার কল হোল্ডে রাখা আছে...’
এই শুনে তক্ষুনি
ফোন নামিয়ে কাঁপতে থাকি, পাছে
আরও অনেক নতুন বাংলা শুনি!
কিছু কিছু সংযোজনা শুনে আমারও মাঝে মাঝে হৃৎকম্প হয়।
ভাষা তার নিজের গতিতে এগোবে— তার মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি, আরও নানা ভাষা ঢুকবে। তার পর একদিন হয়তো সেগুলো বাংলাই হয়ে যাবে। তাকে ঠেকানো উচিত কি না, কিংবা আদৌ ঠেকানো যায় কি না— সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু চেষ্টাকৃত বিকৃতি দেখলে দুঃখ তো হয়ই।
ভাষাকে, উচ্চারণকে সুন্দর করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই বাচিক শিল্পের কাজ। পাশ্চাত্যে বাচিক শিল্পের চর্চা বেড়েছিল সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতকে। এর নানা কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হল শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের ফলে বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে উঠল। সেখানকার শ্রমিকদেরও প্রয়োজন হল নিজেদের বক্তব্যকে, দাবিকে উপরমহলে পৌঁছে দেওয়ার। তাদের মনে হয়েছিল তারা যদি শুদ্ধ, পরিশীলিত ভাষায় কথা বলে, তবে তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। সে ভাবনায় খুব একটা ভুলও ছিল না। সুন্দর উচ্চারণ, শুদ্ধ ভাষা, পরিশীলিত বাচনভঙ্গি অনেক সময়ই বক্তব্যকে জোরালো করে। আমাদের দেশের কথাই ধরি। ব্রিটিশ আমলে যে সব নেতা সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তাঁরা সকলেই ভাল বক্তা ছিলেন। তাঁরা বাংলা, ইংরেজি দু’টোই অবাধে বলতেন। কিন্তু দু’টো মিশিয়ে বলতেন না। আমার মনে হয় আমরা বাচিক শিল্পীরা তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করছি। ওপরচটক না দেখিয়ে শুদ্ধতা আর বুদ্ধিদীপ্ত কথা দিয়েই আমরা ঝলমল করে উঠতে পারি।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ