Plastic

Plastic Management: প্লাস্টিক বর্জন নয়, বর্জ্যের লাভজনক বাজারেই লুকিয়ে সমাধান, প্রয়োজন সচেতনতা

সারকুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির মধ্যেই প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজা হলেও আমরা সে পথে হাঁটতে নারাজ।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:৪৫
Share:

? লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের সঙ্গে।

কলকাতার রাস্তায় তখন ঘরোয়া বেকারির কেক, পেস্ট্রি ফেরি হত। মাথায় কালো পাতলা টিনের ট্রাঙ্ক নিয়ে ফেরিওয়ালা “কেএক, পেএএএএস্ট্রি, পাঁউরুটিইইইই” হেঁকে ঘুরে বেড়াতেন। ডালা খুললে তার থেকে যে গন্ধ বেরত তা ওই ফেরিওয়ালাদের সঙ্গেই সময়ের বুকে হারিয়ে গিয়েছে। পাড়ার দোকানেও পাওয়া যেত। কিন্তু ওই ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেই বাড়িতে ঢুকত কোয়ার্টার পাউন্ড পাঁউরুটি। কয়লার উনুনে সেঁকে, তাতে মাখন আর চিনি দিয়ে খাওয়া হত। স্বাদ ছিল যেন অমৃত।

Advertisement

আর আকর্ষণ ছিল সেই পাঁউরুটির মোড়ক। কাগজের সেই মোড়কটিতে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ। মাখন আসত কলাপাতায় মুড়ে। সেই কলাপাতায় লেগে থাকা মাখনও সযত্নে গরম রুটিতে মাখিয়ে দিতেন মায়েরা।

এখন সেই পাঁউরুটিও মিলছে প্লাস্টিকের মোড়কে! মাখনের মোড়ক তো বদলে গিয়েছে কবেই। প্লাস্টিকে মোড়া আমাদের যাপন করা এই জীবনের বর্জ্য নালায় জমে শহর শুধু ভাসাচ্ছেই না, ধ্বংস করছে আমাদের পরিবেশও। বলছি, “বন্ধ হোক প্লাস্টিকের ব্যবহার।” কিন্তু বললেই কি বন্ধ হবে? লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের সঙ্গে। তাই এই স্লোগানও সেই কাগজের মোড়ক ফিরে পাওয়ার ইচ্ছার মতোই স্বপ্নই থেকে গিয়েছে।

Advertisement

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেই কিন্তু সার বুঝেছিলেন এলেন ম্যাকআর্থার। নেশায় নাবিক। একা সমুদ্রে ভেসে পৃথিবী ভ্রমণের রেকর্ডের অধিকারী এলেন বলেছিলেন, “প্লাস্টিককে বর্জ্য হিসাবে ভাবা বন্ধ করতে হবে। ভাবতে হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদ হিসাবে...।” নাইটহুডের সমতুল্য ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়ে তিনি এখন ডেম এলেন। আর তার তৈরি এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের হাতেই তৈরি হয়েছে পুনর্ব্যবহারযোগ্যতার জন্য ব্যবহার করা প্রতীকটি।

কিন্তু সেই প্রতীক তৈরির ৪০ বছর পরেও মাত্র ১৪ শতাংশ প্লাস্টিক আবার ব্যবহার করা হয়। ৪০ শতাংশ দিয়ে জমি ভরাট করা হয়, ৩২ শতাংশ ইতস্তত প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকে (যেমন আমাদের ড্রেনে), আর বাকি ১৪ শতাংশ পোড়ানো হয় অথবা অন্য ভাবে ব্যবহৃত হয়।

আর এর মূলে রয়েছে অর্থনীতিই। আর একটা তথ্য জানা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর ব্যবহারের জন্য যে কয়েকটি দেশ দায়ী, তাদের অন্যতম পাঁচটিই হল এশিয়ায়— চিন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম এবং শ্রীলঙ্কা।

সারকুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির মধ্যেই প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজা হলেও আমরা সে পথে হাঁটতে নারাজ। ‘সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না’-র রাস্তা হিসাবে ভাবা হয়েছিল দু’টি পন্থা— প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার আর বর্জ্যকে পরিবেশবান্ধব পথে ধ্বংস করতে বিশ্বজুড়ে নতুন শিল্প গড়ে তোলা। কিন্তু এই বৃত্তাকার অর্থনীতি এখনও সেই ভাবে তৈরি হয়ে ওঠেনি, উষ্ণায়ন ‘আমাদের’ পৃথিবীকে ধ্বংস করার রাস্তায় এতটা এগনো সত্ত্বেও।

তবে একেবারেই যে হচ্ছে না তা নয়। বিশ্বজুড়ে বণিক সভাগুলো এগিয়ে আসতে শুরু করেছে বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরি করতে। ভারতে সিআইআই-ও এই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিল্পকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। ১০০টি দেশ যোগ দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের নতুন ‘প্লাস্টিক ট্রিটি’-তে।

বহুজাতিক সংস্থাগুলিও এগিয়ে আসছে এই সমস্যার মোকাবিলায়। সমস্যা হচ্ছে প্লাস্টিক কী ভাবে ব্যবহার করলে তা পরিবেশের ক্ষতি করবে না তা নিয়ে ঐকমত্যের অভাব। যেমন, প্লাস্টিকের কোন ব্যাগ পরিবেশবান্ধব তা নিয়ে রয়েছে সাত রকম ব্যাখ্যা। সমস্যা বাড়াচ্ছে স্যাসের ব্যবহার। বোতলে না কিনে, এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়াটা পকেটের চাপ কমায়। তাই তুলনামূলক ভাবে গরীব দেশগুলিতে প্লাস্টিক স্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি স্থানীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যবহার হওয়া স্যাসে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়ার মতো অনেক দেশেই। না। আমাদের দেশে এ নিয়ে এখনও সে ভাবে কাজ শুরু হয়নি।

বড় দেশগুলির দায় কিন্তু এ ব্যাপারে অনেক। একটি উদাহরণ। রাওয়ান্ডাকে কয়েক কোটি প্লাস্টিক ব্যাগে মশারি দান করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বহু অনুরোধেও সেই প্লাস্টিকের গঠন বৈশিষ্ট জানাতে রাজি হয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার ফলে পরিবেশবান্ধব পথে সেই ব্যাগ নষ্ট করায় অসুবিধা হয়েছিল। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে হইচই হলেও কোনও লাভ হয়নি।

মাথায় রাখতে হবে এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে বছরে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে ৩০ কোটি ৩০ লক্ষ টন (২৭ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন)। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন আজকের তুলনায় বাড়বে তিন গুণ। আর আমরা চাইছি ২০৫০ সালের মধ্যেই “আমাদের” পৃথিবীকে আমাদের বাসযোগ্য করে ধরে রাখতে!

অক্টোবরের শেষে ব্রিটেনে রাষ্ট্রপুঞ্জের ছত্রছায়ায় শুরু হচ্ছে ‘কপ ২৬’ (কনফারেন্স অব পার্টিস)। ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশে অতিরিক্ত কার্বনের মাত্রাকে শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে। আর আমরা দেখছি বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের উৎপাদন আজকের তিনগুণে দাঁড়াবে। এই মুহুর্তে যা প্লাস্টিক তৈরি হয় তার ৭৫ শতাংশই বর্জ্য! আর এখনও পর্যন্ত কিন্তু এই হার কমার কোনও লক্ষণ নেই। যদিও বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে কিন্তু তার প্রভাব এখনও চোখে পড়ার মতো নয়।

অনেকেই বলছেন, এর মূলে দায় সচেতনতার অভাব। অভিযোগের আঙুল উঠছে গণমাধ্যমগুলির দিকে। বলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে এই সমস্যা আর সমাধানের রাস্তা নিয়ে আলোচনা গণমাধ্যমে সেই ভাবে উঠে না আসায়, উষ্ণায়নে সাধারণ ভুগলেও, কেন ভুগছেন তা নিয়ে গভীর সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। এ নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। তবে এটাও তো সত্যি ‘কপ ২৬’ নিয়ে সেই ভাবে আলোচনা গণ মাধ্যমে চোখে পড়ছে কই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন