অন্যান্য দেশে যা-ই হোক, সরকারি পূর্বাভাস বলছে— ভারতে বৃদ্ধির রথের চাকা চলতি অর্থবর্ষে গড়াবে ৭.২ শতাংশ গতিতে। গত বছর বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানে অনুমান, যে সব শিল্পে উৎপাদন ভাল রকম বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে থাকতে পারে কল-কারখানা, বিদ্যুৎ এবং নির্মাণ।
প্রায় একই সুরে তাল মিলিয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের পূর্বাভাস। যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ভারতের অর্থনীতি এগোতে পারে ৭.৫ শতাংশ হারে। যদিও বিশ্ব ব্যাঙ্ক মনে করে, ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়তে পারে। বাড়তে পারে ২.৯% হারে, যা আগের বছর ছিল ৩%। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে অনুমান, আগামী তিন বছর বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধি যেখানে ২.৮ থেকে ২.৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, সেখানে ভারত বাড়বে ৭.৫% হারে। ২০১৯ সালে চিন বাড়তে পারে ৬.২%, যা আগের বছরের তুলনায় ০.৩% কম। মার্কিন অর্থনীতির বৃদ্ধিও ২.৯% থেকে ২.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে ইঙ্গিত তাদের। আর এই জোড়া পূর্বাভাসে ভর করেই এ বার শেয়ার বাজারে অনিশ্চয়তার মেঘ কাটার আশায় দিন গুনছেন লগ্নিকারীরা।
তবে অর্থনীতির এই সম্ভাব্য বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের আশার সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ সহমত নন। বিশেষ করে গত শুক্রবার যেখানে সরকার প্রকাশিত পরিসংখ্যানই জানিয়েছে, নভেম্বরে শিল্প বৃদ্ধি নেমে গিয়েছে ০.৫ শতাংশে। গত ১৭ মাসের মধ্যে সব থেকে কম।
চিন্তা আরও বেশি এই কারণে যে, ওই মাসে শিল্প বৃদ্ধির হার গোত্তা খেয়েছে মূলত কল-কারখানায় উৎপাদন সরাসরি কমে যাওয়ায়। হিসেব অনুযায়ী, কল-কারখানায় উৎপাদন সরাসরি কমেছে ০.৪%। এক বছর আগে ছিল ১০.৪%। ফলে প্রশ্ন উঠেছে বাজারে চাহিদা বাড়েনি বলেই কি কারখানায় উৎপাদন তেমন বাড়াচ্ছে না সংস্থাগুলি? আর এটা সকলেই জানেন, কারখানায় উৎপাদনে গতি না এলে কাজের সুযোগ বাড়া মুশকিল। চিন্তা বাড়াচ্ছে মূলধনী পণ্যের উৎপাদন ৩.৪% কমাও।
ভোটের কারণে অনিশ্চয়তা, চিন-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি, বিশ্ব অর্থনীতির মন্থরতা ইত্যাদি সত্ত্বেও ধরে নেওয়া হচ্ছে, ভারতীয় অর্থনীতি ৭ শতাংশের বেশি হারেই এগোবে। এই কারণে দেশের প্রথম সারির কয়েকটি ব্রোকারেজ সংস্থার অনুমান, এ বছর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, বাজারের উপর তার প্রভাব থাকবে সাময়িক। তাদের আশা, ২০১৯ সালে বাজার কোনও বড় পতন দেখবে না। বরং কিছুটা মাথা তুলতে পারে প্রধান দুই সূচক সেনসেক্স এবং নিফ্টি।
নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই শুরু হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিক ফল প্রকাশের মরসুম। গোড়াতেই ফল নিয়ে হাজির হয় ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক। শেষ তিন মাসে যাদের আয় ১,৮৯৪ কোটি থেকে বেড়ে ২,২৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছলেও, লাভ সেই অনুপাতে বাড়েনি। ৯৩৬ কোটি থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ৯৮৫ কোটিতে। নগদের অভাবে ধুঁকতে থাকা পরিকাঠামোয় ঋণদাতা সংস্থা আইএল অ্যান্ড এফএস-কে দেওয়া অনাদায়ি ঋণই লাভ ততটা না বাড়ার কারণ বলে জানানো হয়েছে।
একই আঘাত লেগেছে বন্ধন ব্যাঙ্কের গায়ে। বন্ধনের আয় ১,৩৩৬ কোটি থেকে বেড়ে ১,৮৬৪ কোটিতে পৌঁছেছে। কিন্তু নিট লাভ মাত্র ৩১ কোটি টাকা বেড়ে স্পর্শ করেছে ৩৩১ কোটি। কারণ, আইএল অ্যান্ড এফএস-কে দেওয়া ৩৮৫ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ি হওয়ায় সেই খাতে সংস্থান করতে হওয়া।
তবে ফল ভাল করেচে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টিসিএস। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আয় ৬,৪৩৬ কোটি বেড়ে হয়েছে ৩৭,৩৩৮ কোটি। নিট মুনাফাও ৬,৫৩১ কোটি থেকে এক লাফে উঠে এসেছে ৮,১০৫ কোটি টাকায়। তবে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস তুলনায় হতাশ করেছে বাজারকে। তাদের মুনাফা কমেছে ৩০%। নেমেছে ৩,৬১০ কোটি টাকায়। আগের বছর একই মেয়াদে সংস্থার লাভ হয়েছিল ৫,১২৯ কোটি টাকা।
ফল প্রকাশের পাশাপাশি ফের বাজার থেকে নিজেদের ৮,২৬০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে ফেরানোর পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছে ইনফোসিস। অনধিক ৮০০ টাকা দামে সংস্থা শেয়ার ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুক্রবার শেষ বেলায় তাদের শেয়ারের বাজার দর ছিল ৬৮৩ টাকা। শেয়ার পিছু ৪ টাকা করে বিশেষ ডিভিডেন্ডও দেবে তারা।
১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক এক করে প্রকাশিত হতে থাকবে বাকি সব সংস্থার আর্থিক ফলাফল। আপাতত সে দিকেই নজর রাখবে বাজার। আর কোন সংস্থার হিসেবের খাতার অবস্থা কী রকম দাঁড়াল, তার প্রভাবে আন্দোলিত হবে বিভিন্ন শেয়ারের বাজার দর।
(মতামত ব্যক্তিগত)