বলি ব্যবসা
গো-হত্যা ঘিরে রাজনীতির মাসুল গুনছে দেশের চর্মশিল্প।
কাঁচা চামড়ার জোগানের টানে সমস্যার পাঁকে ট্যানারি। কাজ হারানোর মুখে প্রায় দু’লক্ষ শ্রমিক। আবার ভিন্ দেশ থেকে নগদে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হওয়ায়, টান পড়ছে মূলধনে। ফলে উৎপাদন ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। কমছে রফতানিও। এই জোড়া সঙ্কটে জেরবার হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গও।
চর্ম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গো-হত্যা নিয়ে বিতর্ক। বিভিন্ন রাজ্যে তা বন্ধ করার ফরমান। আর সব থেকে বেশি করে রাজনৈতিক পরিসরে এ নিয়ে ক্রমাগত জলঘোলা হতে থাকা। মূলত এই ত্র্যহস্পর্শেরই বলি দেশের ১,১০০ কোটি ডলারের (প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা) চর্মশিল্প। পরিস্থিতি এমনই যে, কাঁচা চামড়ার অভাবে খাবি খাচ্ছে দেশের প্রায় দেড় হাজার ট্যানারি। রুজি-রুটি হারাচ্ছেন সেখানে কাঁচা থেকে তৈরি চামড়া প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত বহু শ্রমিক।
সমস্যার শিকড় কোথায়, তা এ রাজ্যের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট। কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজার দাবি, পশ্চিমবঙ্গে চর্মশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার মাত্র ২০% স্থানীয়। বাকি ৮০% আসত অন্য রাজ্য থেকে। তার মধ্যে আবার ২৫ শতাংশের জোগান দিত একা মহারাষ্ট্রই। কিন্তু গো-হত্যা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই জোগান কার্যত শুকিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ চামড়া ব্যবসায়ীদের। তাঁদের কথায়, অনেক রাজ্য থেকে কাঁচা চামড়া আসা ৪০-৫০% কমে গিয়েছে। কোথাও থেকে আসা একেবারে বন্ধ। এই অবস্থায় জোড়া সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।
প্রথমত, কাঁচা চামড়া কেনার পরে বিভিন্ন ধাপে তার প্রক্রিয়াকরণ করা হয় ট্যানারিতে। তৈরি হয় চামড়ার চাদর। তার থেকে ব্যাগ-জুতো-বেল্টের মতো বিভিন্ন চর্মপণ্য তৈরি করে সংস্থাগুলি। এখন ভিন্ রাজ্য থেকে কাঁচামালের জোগানে টান পড়ায় বিদেশ থেকে তা আমদানিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। কিন্তু সমস্যা হল, বিদেশ থেকে সরাসরি প্রক্রিয়া করা চামড়াই কিনতে হয়। ফলে ট্যানারির কাজ কার্যত থাকছে না। আমদানি বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক, দু’পক্ষই সমস্যায়। বানতলার চর্ম ব্যবসায়ী ও কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের সদস্য জিয়া নাফিসের অভিযোগ, এই কারণে দেশে প্রায় দু’লক্ষ কর্মী রুজি-রুটি হারানোর মুখে।
দ্বিতীয়ত, এই কারণে সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। কলকাতা লেদার ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্তা ইমরান আহমেদ খান জানান, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় নগদ টাকায় টান পড়ছে। কারণ, ভিন্ রাজ্য থেকে কাঁচা চামড়া কেনার টাকা মেটাতে সময় পাওয়া যেত। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানির টাকা মেটানোর পরে তবে সেই কাঁচামাল হাতে আসে। ফলে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাচ্ছেন অনেকে।
আর এই ছবি শুধু এ রাজ্যের নয়। সারা দেশেরই। গো-হত্যা নিয়ে রাজনীতির আকচাআকচিতে সঙ্কটে ১,৫০০ ট্যানারি। অথচ চর্মশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১০ লক্ষ মানুষের রুজি-রোজগার। রাজনীতি আর সরকারি ফরমান নিয়ে বিভ্রান্তি চর্মশিল্পকে কতখানি অসুবিধায় ফেলেছে, তা স্পষ্ট জুনেজার কথাতেই। তাঁর অভিযোগ, ‘‘গো-হত্যা অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ। কিন্তু অন্য রাজ্য থেকে মোষ এমনকী ছাগলের চামড়া নিয়ে আসতেও বাধা দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। মোটা অঙ্কের তোলা চাইছে। চাহিদা না-মিটলে মারধরও করা হচ্ছে।’’
দেশে কাঁচা চামড়ার জোগান কী ভাবে কমেছে, তা স্পষ্ট তৈরি চামড়া আমদানির বাড়বাড়ন্তের পরিসংখ্যানে। ২০১৪-’১৫ সালে ৩৫০ কোটি টাকার তৈরি চামড়া আমদানি করেছিল ভারত। ২০১৫-’১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটি। বৃদ্ধি প্রায় ৭০%। গত এক বছরে ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড ও আফ্রিকায় চামড়ার রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৫%।
একে ইউরোপ-সহ বিশ্ব বাজারে চাহিদায় ভাটা। তার উপর কাঁচা চামড়ার সমস্যা প্রতিযোগিতায় আরও পিছনে ঠেলছে ভারতকে। ২০১৪-’১৫ সালে চামড়ার জিনিসের মোট রফতানি ছিল ৬৪৯ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে তা নেমে এসেছে ৫৮৬ কোটি ডলারে। কমে গিয়েছে প্রায় ১০%।