রোবটের কাছে মানুষ ‘খাটনির কাজ’ খোয়াতে শুরু করেছে আজ অনেক দিন। সহজেই তা টের পাওয়া যায় বড়-বড় কারখানায়। কিন্তু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দাপট এখন থাবা বসাচ্ছে ‘মাথার কাজে’ও। যার মাশুল গুনে কাজ খোয়াচ্ছেন এ দেশের বহু তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। আর এই শিল্পে কর্মীদের একটি বড় অংশই যেহেতু দক্ষিণ ভারতীয় ও বাঙালি, তাই কাজখেকো প্রযুক্তির এই বিপদ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এ রাজ্যও।
ইনফোসিস থেকে টেক মহীন্দ্রা— ছাঁটাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাতেই। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম ও উপদেষ্টা সংস্থা বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের গত এক বছর ধরে চালানো সমীক্ষায় উঠে এসেছে নতুন প্রযুক্তিকে জায়গা করে দিতে এই পুরনো প্রযুক্তি-নির্ভর কাজ ব্রাত্য হওয়ার কথা। ন্যাসকমের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫-’১৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ৮.৬% হারে বেড়েছে। কর্মী সংখ্যা বেড়েছে ৫%।
গত পাঁচ বছর ধরেই ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। এইচ-১বি ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি। আর কল সেন্টারের আউটসোর্সিং রুখতে মার্কিন কংগ্রেসে আসা বিল। ট্রাম্পের জমানায় ধেয়ে আসা এই জোড়া ধাক্কার সঙ্গে এখন মাথাব্যথার কারণ হয়েছে অটোমেশন, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো প্রযুক্তির দাপট।
ভারত থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রফতানি গত ৫ বছরে বেড়েছে ১৩.৭%। কিন্তু কাজের সুযোগ বেড়েছে মাত্র ৮%। কারণ প্রযুক্তির রমরমা। এর জেরে বিপিও, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা শিল্পের বিভিন্ন কম দক্ষতার কাজ মার খাচ্ছে। এ বার সেই তালিকায় ঢুকে পড়ছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, টেস্টিংয়ের মতো কাজও।
চাকরিখেকো প্রযুক্তি
ভয়ের কারণ
গায়ে-গতরে খেটে করার অনেক কাজ যন্ত্র আগেই কেড়েছে। এখন মাথার কাজও ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছে কম্পিউটার। যে-সব প্রযুক্তি ঘুম কাড়ছে, তার মধ্যে রয়েছে-
অটোমেশন: স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। একই কাজ বারবার করতে হয়, এমন জায়গায় যন্ত্রের ব্যবহার। শুধু সেই অনুযায়ী প্রোগ্রাম করলেই হল। গাড়ির অ্যাসেম্বলি লাইন থেকে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র— ব্যবহার সর্বত্র
মেশিন লার্নিং: আশপাশে কী ঘটছে, তা মানুষের মাথা কী ভাবে আঁচ করে, সেটি শেখানো হচ্ছে মেশিনকে। যাতে সেই কাজ সেরে ফেলে মেশিনই। যেমন, স্মার্টফোনে কয়েকটি বর্ণ লিখতেই, তা ক্রমাগত দেখাতে থাকে যে, সেগুলি দিয়ে কী কী শব্দ লেখা সম্ভব
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: কৃত্রিম মেধা। কোনও কাজ অনেক ভাবে করা সম্ভব হলে, মানুষ তার মধ্যে সেরাটি বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে মেশিনও তাই। হাতেগরম উদাহরণ, দাবা খেলতে গিয়ে কম্পিউটারের চাল বাছাই
* তথ্যসূত্র: হর্সেস ফর সোর্সেস রিসার্চ ও বিশ্বব্যাঙ্ক
আশঙ্কার ছবি
কাজের সুযোগ কমছে ৫ বছর ধরেই
২০১৫-’১৬ সালে নিয়োগের কথা ছিল ২.৭৫ লক্ষ কর্মী। হয়েছে ২ লক্ষ
আগামী দিনে তা আরও কমার সম্ভাবনা। ২০২১-এর মধ্যে কাজ কমবে ৬.৪ লক্ষ
৪ বছরে কমতে পারে ৬৯% চাকরি
গত বছর ইনফোসিস ও উইপ্রোয় মেশিন কাজ কেড়েছে প্রায় ৭ হাজার কর্মীর
২০১৬ সালে ১২% লোক কম নিয়েছে টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস ও এইচসিএল
ছাঁটাইয়ের খবর মিলেছে কগনিজ্যান্ট, ক্যাপজেমিনি, টেক মহীন্দ্রাতেও
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কর্মী সংগঠনের দাবি, কগনিজ্যান্ট, ইনফোসিস, উইপ্রো-সহ বড় মাপের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মী ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। গত এক মাসে প্রায় ১০০ জন চাকরি খুইয়েছেন। ফোরাম ফর আইটি অ্যান্ড আইটিইএস এমপ্লয়িজ (ফাইট)-এর কলকাতা শাখার দ্বারস্থ হয়েছেন এঁরা। সংগঠনের মুখপাত্র কিংশুক চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, কর্মীদের জন্য আইনি লড়াইয়ে নামতে তাঁরা প্রস্তুত। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যেই কলকাতার বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কর্মী সরানো হয়েছে। এঁদের নতুন প্রকল্পে নিয়োগও করা হয়নি। চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার দিন গুনছেন তাঁরা।
তবে ন্যাসকমের প্রেসিডেন্ট আর চন্দ্রশেখরের দাবি, ‘‘অনিশ্চয়তা কাটবে। নতুন কাজের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনেক সংস্থায় শুরু হয়েছে।’’ সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, নয়া প্রজন্মের ৮টি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে তৈরি হচ্ছে ৫৫টি কাজ। সোশ্যাল মিডিয়া, তথ্য বিশ্লেষণ, থ্রিডি প্রিন্টিং, কৃত্রিম মেধা, রোবোটিক্স, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদির হাত ধরে বিশ্বে তৈরি হবে ৬০-৮০ লক্ষ কাজের সুযোগ। যার অন্তত ২৫% ভারতে হবে বলেই ধারণা সংশ্লিষ্ট মহলের।