এখন ব্যাঙ্কের দরজায় পা রাখলে, ছোটবেলার সেই খেলনাওয়ালার কথা মনে পড়ে। পাড়ায় যার হাঁক শুনলেই দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে আসতাম আমরা। যে ছেলের পায়ের তলায় সর্ষে, প্রথমেই সে লাট্টু তুলে নিত ঝাঁকা থেকে। আবার যে মেয়েটি নিপাট শান্তশিষ্ট, সে বেছে নিত মিষ্টি মুখের পুতুলখানা। অর্থাৎ, যার যেমন পছন্দ, ঠিক সেই অনুযায়ী খেলনা বাছাই। এই সে দিন একগুচ্ছ নতুন গৃহঋণের কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে বহু দিন পরে সেই পুরনো খেলনাওয়ালার কথাই মনে পড়ে গেল।
ঋণের এই ছোট্ট ঝুড়ি...
আজকের প্রজন্ম বাড়ি কেনার জন্য আর মাথার চুল পাকার অপেক্ষা করে না। হাপিত্যেশ করে বসে থাকে না অবসরের পরে থোক টাকা হাতে আসার জন্য। তার বদলে বরং তিরিশ-চল্লিশেই পছন্দের ফ্ল্যাটের চাবি তাদের অনেকের পকেটে। সৌজন্যে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো হাতে আসা গৃহঋণ।
কিন্তু এখন সেই বাড়ি কিনতে ধারও বিভিন্ন ব্যাঙ্ক দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকের প্রয়োজন মাথায় রেখে। কোনও মহিলা হয়তো চাকরির জন্য মাথা গোজার ঠাঁই চাইছেন কোনও বড় শহরে। অন্য কারও উপর নির্ভর না-করে নিজেই এক চিলতে বাসা জোগাড় করতে চান তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়োজন এক রকম। আবার কেউ হয়তো আর্থিক ভাবে তেমন সচ্ছল নন। ছাদ জোগাড়ের জন্য তিনি খুঁজছেন সরকারি সাহায্যের হাত। সুতরাং দরকার সেই গৃহঋণ হলেও, তাঁর চাহিদার ধাঁচ কিছুটা অন্য। এই সমস্ত মাথায় রেখেই এখন বেশ কিছু উদ্ভাবনী গৃহঋণ প্রকল্প এনেছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। বাড়ি কিনতে নেওয়া গড়পড়তা ধারের থেকে যা বেশ কিছুটা আলাদা। আজকের লেখায় তাদের কয়েকটিকে নিয়েই আলোচনা করব আমরা—
বেতন মেপে কিস্তি
• চালু করেছে স্টেট ব্যাঙ্কের মতো কয়েকটি ব্যাঙ্ক।
• বাড়ি কেনার জন্য কত টাকা পর্যন্ত ধার পেতে পারেন, তা নির্ভর করে আপনার রোজগারের উপর। ফি-মাসে কত টাকা শোধ করা সম্ভব, তা যাচাই করেই ঋণ অনুমোদন করে কোনও ব্যাঙ্ক। এই প্রকল্পে সেই সর্বোচ্চ সীমার থেকেও ঋণের অঙ্ক কিছুটা বেশি পেতে পারেন আপনি।
• ফ্লেক্সি-পে হোম লোন’ প্রকল্পে সাধারণ গৃহঋণের ঊর্ধ্বসীমার তুলনায় ২০% পর্যন্ত বেশি ধার পেতে পারেন আবেদনকারী।
• সুবিধা রয়েছে বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাসিক কিস্তির (ইএমআই) অঙ্ক ঠিক করারও।
• সাধারণত গৃহঋণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো মেয়াদেই মাসিক কিস্তির অঙ্ক একই থাকে। অথচ প্রথম দিকে বেতন থাকে তুলনায় অল্প। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আপনার ইএমআই হবে কম। ফলে বেতন কম হলেও, সুবিধা হবে তা সামাল দিতে। পরে বেতন বাড়লে, তাল মিলিয়ে বাড়াতে পারবেন কিস্তির অঙ্ক। অর্থাৎ, শুরুতে রোজগার কম হওয়ায় ঋণের কিস্তি কম। পরে বেতন বাড়লে, বাড়বে মাসিক কিস্তিও।
• কিছুটা বেশি মিলবে ঋণ শোধের থেকে রেহাই পাওয়ার সময়ও (মোরেটোরিয়াম)। অনেক সময় ধার নেওয়ার পরে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা শোধ করতে হয় না। একেই বলে মোরেটোরিয়াম। সাধারণ গৃহঋণে ওই মেয়াদ হয় মোটামুটি ভাবে ১৮ থেকে ৪৮ মাস। ফ্লেক্সি পে-তে মোরেটোরিয়াম মিলবে ৬০ মাস।
তবে শর্ত হল, আবেদনকারীর বয়স হতে ২১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। ঋণের আবেদন করতে আগে চাকরি করতে হবে অন্তত দু’বছর।
• ঋণের ন্যূনতম অঙ্ক ২০ লক্ষ টাকা। lশোধের মেয়াদ ২৫-৩০ বছর।
জমি কিনতে গৃহ ঋণ!
শুধু বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে নয়, এখন জমি কেনার জন্যও গৃহঋণ দিচ্ছে কিছু ব্যাঙ্ক। যেমন, স্টেট ব্যাঙ্কের এসবিআই রিয়েলটি প্রকল্প।
• এতে ধার পাওয়া যাবে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত।
• তবে তা দিয়ে জমি কিনতে হবে শুধুমাত্র বাড়ি করার জন্যই (বাণিজ্যিক কারণে নয়)। এবং তা তৈরি করতে হবে জমি কেনার দু’বছরের মধ্যে।
• কোনও ন্যায্য কারণে জমি হাতে পেতে দেরি হলে অবশ্য ওই সময়সীমা বাড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
• তেমনই আবার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া বাড়ি তৈরি শুরুতে দেরি হলে, গুনতে হবে জরিমানা।
• প্রকল্পে ঋণ শোধের জন্য সময় মিলবে ১৮০ মাস (১৫ বছর)।
বাড়ির আগেই ধার
সাধারণত ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে তার দাম সংক্রান্ত নথি জমা দিলে তবেই গৃহঋণ মেলে। কিন্তু এখন বাজারে এসেছে এমন কিছু গৃহঋণ, যা ফ্ল্যাট কেনার জন্য কোনও পদক্ষেপ করার আগেই মঞ্জুর করিয়ে নেওয়া সম্ভব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে।
• এই আগাম ধার পেতে প্রথমে আবেদন করতে হবে ব্যাঙ্কের কাছে।
• আবেদনকারীর ঋণ শোধের ক্ষমতা যাচাই করে তার সর্বোচ্চ অঙ্ক ঠিক করবে ব্যাঙ্ক। মঞ্জুর হবে ঋণ। সেই সূত্রে হাতে চিঠিও পাবেন আবেদনকারী।
এ ভাবে টাকার সংস্থান আগেই নিশ্চিত করে ফ্ল্যাট খুঁজতে বেরোতে পারবেন তিনি।
• তবে চিঠি পাওয়ার মোটামুটি চার মাসের মধ্যে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।
• এই প্রকল্পে ঋণ পেতে জমির দলিল বা ফ্ল্যাটের কাগজপত্র জমা দিতে হবে না। কিন্তু গৃহঋণ পেতে প্রয়োজনীয় বাকি সব নথিই আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
• ঋণের অঙ্ক হতে হবে অন্ততপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা।
ধারেও প্রাপ্তি!
• নাম ম্যাক্স গেইন প্রকল্প।
• এখানে যে অ্যাকাউন্ট থেকে গৃহ ঋণের মাসিক কিস্তি কাটবে, সেখানে বাড়তি টাকা রেখে সুদ বাবদ রোজগার করতে পারেন আপনি। ওই সুদের হারও গৃহ ঋণে সুদের সমানই।
• ধরুন, মাসিক কিস্তি ২০ হাজার টাকা। আর আপনি হাতে বেতন পান ৫০ হাজার। মনে করুন, এ বার ওই বেতনের টাকা গৃহঋণ অ্যাকাউন্টেই জমা রাখলেন। সে ক্ষেত্রে কিস্তি বাবদ ২০ হাজার টাকা কাটা যাবে। বাকি ৩০ হাজার যত দিন না তুলবেন, তত দিন তাতে সুদ মিলবে।
• সুদ সরাসরি হয়তো পাবেন না। কিন্তু ধরে নেওয়া হবে যে, ওই বাড়তি টাকাও গৃহঋণ শোধের জন্য জমা রেখেছেন। তাই যত দিন তা না-তুলবেন, তত দিনের জন্য আপনার বকেয়া ঋণ ৩০ হাজার টাকা কম ধরে তার উপর সুদ হিসাব করা হবে। অর্থাৎ, গৃহ ঋণে সুদের হার যদি ১০.৫% হয়, তাহলে ওই ক’দিনের জন্য ৩০ হাজার টাকার উপর কার্যত ১০.৫% সুদ পেলেন আপনি। যা অধিকাংশ সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুদের দু’গুণেরও বেশি।
• তবে এই প্রকল্পে গৃহঋণের অঙ্ক অন্তত ২০ লক্ষ টাকা হতে হবে।
• গৃহঋণের অ্যাকাউন্টটি হবে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। যাতে যখন খুশি টাকা জমা করা ও তোলা যায়।
• মিলবে চেকবই এবং নেট ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধাও।
• যাঁরা সাধারণ গৃহঋণ নিয়েছেন, তাঁরাও ইচ্ছা করলে তা ম্যাক্স গেইন প্রকল্পে নিয়ে যেতে পারেন। তবে তার জন্য এককালীন ২,০০০ টাকা চার্জ দিতে হবে। আর প্রকল্পে আসার সময় বকেয়া ঋণের অঙ্ক হতে হবে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকা।
আশার আলো
• প্রকল্পের নাম আশা হোম লোন।
• চালু করেছে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক।
এই ঋণ পাওয়া যাবে শুধু প্রথম বাড়ি করা বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য।
• প্রকল্পটি তৈরিও করা হয়েছে মূলত দেশের তুলনামূলক ভাবে কম আয়ের মানুষের দিকে তাকিয়ে।
• যেখানে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা হবে, সেখানকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ঠিক হবে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা। তা হতে পারে ১ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
• সম্পত্তির বাজার মূল্যের ৯০% পর্যন্ত ধার হিসেবে পাওয়া যাবে।
• ঋণ নেওয়া যাবে পুরনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্যও।
• বাসস্থান তৈরির জন্য জমি কিনলেও ধার দেবে ব্যাঙ্ক।
• শোধের মেয়াদ ৩০ বছর পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা
নাম থেকেই পরিষ্কার যে, এই প্রকল্প কোনও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নয়। দেশের সমস্ত মানুষের মাথায় পাকা ছাদের বন্দোবস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। যার বৈশিষ্ট্য—
• এই পাকা বাড়িতে থাকবে জলের ব্যবস্থা, শৌচালয় ও বৈদ্যুতিক আলো।
• আবেদনকারী বিবাহিত পুরুষ হলে, আবেদনপত্রটি যৌথ নামে করতে হবে। প্রথম নাম হবে স্ত্রীয়ের।
• ঋণে পাওয়া যাবে আয়কর ছাড়।
• শোধের সময়সীমা ১৫ বছর।
• এই প্রকল্পটিকে ভিত্তি করে নিজস্ব ব্র্যান্ড-নামে গৃহঋণ প্রকল্প চালু করেছে কিছু ব্যাঙ্ক। যেমন, ইউনাইটেড অ্যাফোর্ডেব্ল হাউজিং লোন স্কিম চালু করেছে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া।
• এই প্রকল্পে ৬.৫% হারে সুদে ছাড় মিলবে। তবে ঋণের পরিমাণ যা-ই হোক, ওই সুবিধা পাওয়া যাবে ছ’লক্ষ টাকা ঋণের উপরই। যেমন, সুদ ১০.৫% হলে, ৬ লক্ষ টাকার উপর সুদ দিতে হবে ৪% হারে। ধারের বাকি টাকায় অবশ্য পুরো ১০.৫% সুদই গুনতে হবে গ্রাহককে।
তবে সুদে এতখানি ছাড় পাওয়ার কিছু শর্তও আছে। যেমন—
• দেশের আর কোথাও পাকা বাড়ি বা ফ্ল্যাট থাকলে, এই প্রকল্পে ঋণ পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন না আবোদনকারী।
• শুধু শহরাঞ্চলে বাড়ি করা বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেই এই ঋণ মিলবে। কোন কোন এলাকায় এই প্রকল্পের সুবিধা প্রাপ্য, তার নির্দিষ্ট তালিকাও রয়েছে। তা পাওয়া যাবে ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাঙ্ক এবং কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে। চার হাজারেরও বেশি এলাকা রয়েছে ওই তালিকায়।
• পারিবারিক আয় হতে হবে বছরে ছ’লক্ষ টাকার মধ্যে। এখানে পরিবার মানে স্বামী, স্ত্রী, অবিবাহিত পুত্র এবং কন্যা। বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে দুটি শ্রেণি করা হয়েছে। আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষের (ইকনমিকালি উইকার সেকশন) জন্য আয়ের ঊর্ধ্বসীমা ৩ লক্ষ টাকা। নিম্নবিত্তের (লো ইনকাম গ্রুপ বা এলআইজি) জন্য ৬ লক্ষ।
lবাড়ি বা ফ্ল্যাটের আয়তন সাধারণ ভাবে প্রথম শ্রেণির ক্ষেত্রে ৩০ বর্গ মিটার আর দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য ৬০ বর্গ মিটারের মধ্যে হতে হবে। তবে ব্যাঙ্কগুলি ইচ্ছা করলে সামান্য কিছু হেরফের করতে পারে।
শেষ পাত
এমন একেবারেই নয় যে, বাজারে উদ্ভাবনী ঘরানার বা একটু অন্য রকম গৃহঋণ আর নেই। কিংবা সরকারের ঘরে মজুত নেই আর কোনও আবাসন প্রকল্প। এখানে আসলে নিছকই উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি প্রকল্পকে তুলে ধরলাম আমরা। যাতে সে সম্পর্কে জানলে সকলের কিছুটা অন্তত লাভ হয়। একই সঙ্গে, আমরা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করি, এ ধরনের বাকি প্রকল্পের খোঁজ-খবর নিতে।
আজ হোক বা কাল। মাথার উপর ছাদ জোগাড়ের জন্য খোঁজ তো সেই শুরু করতেই হবে। তা হলে আর দেরি করে লাভ কী? তাই না?