সান্তার স্লেজে মোটা মুনাফার উপহার এ বার নেই। নোট বাতিলের ধাক্কায় যা পরিস্থিতি, তাতে অন্তত মার্চ পর্যন্ত চাহিদা চাঙ্গা হওয়ার কোনও আশাই দেখছে না বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য শিল্প। খুব নিশ্চিত হতে পারছে না পরিস্থিতি কত দিনে পুরোপুরি শোধরাবে, তা নিয়েও।
পুজো, দীপাবলির উৎসব-মরসুমে এ বার চুটিয়ে ব্যবসা করেছে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য শিল্প। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার বিক্রি হয়েছে রমরমিয়ে। আশা ছিল, ভাল বর্ষা আর সপ্তম পে কমিশনের ‘জোড়া আশীর্বাদে’ লাভের কড়ি উপচে পড়বে বছর শেষের বিক্রিবাটাতেও। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছে নোট কাণ্ড। পরিস্থিতি এতই সঙ্গিন যে, বিক্রি ৭০% ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা করছে তারা। সেই কারণে পিছিয়ে দিতে হচ্ছে দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা। কাঁচি চালাতে হচ্ছে বিপণন বাজেটেও।
টানা দু’বছর মিইয়ে থাকার পরে এ বার উৎসবের মরসুমে বিকিকিনি ভাল হয়েছিল গোদরেজ, এলজি, সোনি, স্যামসাং, প্যানাসনিক, ভিডিওকনের মতো সংস্থাগুলির। বাজার ভাল আঁচ করে তখন বিজ্ঞাপন ও বিপণনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল তারা। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। বিক্রি বেড়েছিল ৪০%। নভেম্বরে বিয়ের মরসুম। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের ছুটি। ফলে এই সময়ে ফের এক বার চুটিয়ে ব্যবসা করার আশা করেছিল বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য শিল্প। কিন্তু নোট বাতিলের জেরে নভেম্বরে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনারের বিক্রি প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এই সময় সাধারণত যা ব্যবসা হয়, নেমে এসেছে তার ৫০ শতাংশে। ডিসেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে বড় শহরে ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিল্পের মতে, তা নেহাতই সামান্য। এ মাসে এখনও পর্যন্ত বিক্রি অন্তত ৩০% কম বলে তাদের দাবি।
মার্চের আগে বাজারের হাল ফেরার সম্ভাবনা নেই আঁচ করে স্থগিত থাকছে পণ্যের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনাও। সাধারণত জানুয়ারিতে দাম বাড়ে। যন্ত্রাংশের দর বাড়ায় এ বারও ২০১৭ সালের গোড়ায় ৫% তা বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখছে সংস্থাগুলি। প্যানাসনিক ইন্ডিয়ার প্রধান মণীশ শর্মা জানান, জানুয়ারিতে দাম বাড়ছে না। তাঁর মতে, চাহিদায় ভাটা কাটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এপ্রিল পর্যন্ত। তবে এলইডি প্যানেলের দাম ১০% বাড়ায় টিভির দাম ৫% চড়ছে। বাকি ৫ শতাংশের বোঝা বইবে সংস্থাগুলি।
ভারতে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য বাজারের ৬৫% শহরকেন্দ্রিক। বাকি ৩৫% গ্রামের দখলে। কিন্তু কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েন্সেস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ওই বাজার দ্রুত বাড়ছে। তা অসম্ভব সম্ভাবনাময়। সংস্থাগুলির আশা ছিল, এ বার ভাল বর্ষার পরে গ্রাম ও আধা-শহরে বিক্রি বাড়বে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তা না হওয়ায় মুষড়ে পড়েছে তারা।
মাসিক কিস্তি ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন কেনার চল রয়েছে মূলত শহরে। গ্রামে তার ব্যবহার এখনও খুব কম। সেখানে নগদে কেনাকাটায় অভ্যস্ত সকলে। পরিসংখ্যান বলছে, শহরে দামি জিনিসের বিক্রি ৬০% ক্ষেত্রে কার্ড বা কিস্তি-নির্ভর। বাকি ৪০% নগদে। সেখানে গ্রামে তা প্রায় ১০০%। নগদ বাড়ন্তের এই বাজারে স্বাভাবিক ভাবেই ভাটা পড়েছে সেখানে।
বিক্রি কমেছে শহরেও। বড়দিনে সান্তা ক্লজের স্লেজ গাড়ি ঢুকে পড়ার সময় প্রায় হয়ে এল। দেওয়ালে ক্যালেন্ডার বদলে যেতেও আর মাত্র কয়েক দিন। এই সময় ফ্রিজ-টিভি কিনতে যে ভিড় শপিং মল কিংবা বিপণিগুলিতে সাধারণত চোখে পড়ে, তা অনেকটাই উধাও।
ব্যাঙ্কে টাকা আছে। কিন্তু তা তোলার জো নেই। অধিকাংশ এটিএম হয় খালি, নয়তো নোট ভরতেই জলদি ফাঁকা। নোটের জোগান কবে স্বাভাবিক হবে, বলতে পারছে না সরকারও। এই পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে খরচে রাশ টানছেন শহরবাসী। কার্ড ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ হলেও ভাবছেন, আর দু’দিন পরে কিনলে ক্ষতি কী? যে কোনও আর্থিক অনিশ্চয়তাতেই সাধারণ মানুষ খরচে রাশ টানেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা কৌশল আঁকড়ে ধরছে সংস্থাগুলি। এলজি ইন্ডিয়ার বিপণন প্রধান নিলাদ্রি দত্ত বলেন, ‘‘নগদের টানাটানিতে ক্রেতাকে স্বস্তি দিতে জিনিস কেনার তিন মাস পর থেকে কিস্তি চালু করা হচ্ছে। কেনার সময় লাগছে না ডাউন পেমেন্টও।’’ একই পথে হেঁটেছে স্যামসাং। তবে নোট সঙ্কট নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ তারা। এ বিষয়ে সংস্থার মুখপাত্রকে ফোন করে বা এসএমএস পাঠিয়ে কোনও উত্তর মেলেনি।
লাভের ঘরে এই ঘাটতি সামলাতে বাধ্য হয়ে দৈনন্দিন খরচে রাশ টানছে বিভিন্ন সংস্থা। টান পড়ছে বিপণন বাজেটে। বাজার পরে উঠবে এই আশায় এখনই এসি-ফ্রিজের উৎপাদন কমানো হচ্ছে না। গোদরেজ অ্যাপ্লায়েন্সের অন্যতম কর্তা কমল নন্দী জানান, গ্রীষ্মে এ সব জিনিসের চাহিদা বাড়ে। তা মাথায় রেখে সেগুলি তৈরি কমানো হচ্ছে না। ফলে কোপ পড়ছে বিপণন বাজেটে।
নোট-ধাক্কা সামলে ছন্দে ফিরতে সংস্থাগুলির অপেক্ষা এখন বাজারে নগদ ফেরার। একই সঙ্গে, জিএসটি চালু, বাজেট আর কড়া গ্রীষ্মের দিকেও চাতকের মতো তাকিয়ে রয়েছে বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য শিল্প।