শুল্ক নিয়ে শুধুই ‘ফাঁকা’ আওয়াজ! আমজনতাকে বোকা বানাতে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে চমৎকার ‘অভিনয়’ করে চলেছেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে তাঁর কীর্তিকলাপ ফাঁস করলেন খোদ হোয়াইট হাউসের এক পদস্থ আধিকারিক। আর সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জু়ড়ে পড়ে গিয়েছে হইচই। অন্য দিকে, বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের গায়ে ‘মিথ্যাবাদী’ তকমা সেঁটে যাওয়ায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি, শুল্ক বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে দেওয়া ট্রাম্পের ‘অতিনাটকীয় হুঙ্কার’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন হোয়াইট হাউসের এক পদস্থ কর্তা। ওভাল অফিসের ‘হাঁড়ির খবর’ ফাঁস করে দেওয়া ওই আধিকারিকের পরিচয় অবশ্য গোপন রেখেছে আমেরিকার প্রতিটি গণমাধ্যম। তবে তাঁর করা মন্তব্য ইতিমধ্যেই ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হয়েছে সমাজমাধ্যমে। সেখানে প্রেসিডেন্টের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে ভুয়ো বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে ঠিক কী বলেছেন ওই আধিকারিক? তিনি জানিয়েছেন, বাণিজ্যচুক্তি করার জন্য ৯০ দিনের যে চূড়ান্ত সীমারেখা প্রেসিডেন্ট দিয়েছিলেন, তা আসলে অর্থহীন। কারণ ওই সময়সীমা ফুরিয়ে এলেও হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে মারাত্মক তাড়াহুড়ো রয়েছে, এমনটা নয়। বরং আলোচনা করে সময় নিয়ে কিছুটা ধীরেসুস্থে এগোতে চাইছে মার্কিন অর্থ এবং বাণিজ্য মন্ত্রক।
মার্কিন গণমাধ্যমে করা মন্তব্যে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানেন যে তাঁর জমানায় সবচেয়ে আলোচিত এবং আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হতে চলেছে শুল্ক। তাই খুব সহজে সেখান থেকে তিনি দূরে সরে যাবেন এমনটা নয়। তবে এটা এড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে আমরা বাণিজ্যচুক্তি করতে যাচ্ছি, তাতে কোনও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অথচ প্রেসিডেন্টের হাবভাব মঞ্চস্থ হওয়া নাটকের মতো, যাতে তিনি নিজেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন।’’
ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলার দায়িত্ব মোট তিন জন আধিকারিকের কাঁধে তুলে দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁরা হলেন ট্রেজ়ারি সচিব স্কট বেসেন্ট, বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক এবং বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। সূত্রের খবর, এই তিন জনের হাতে বৈদেশিক চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নেই। তবে এ ব্যাপারে এগিয়ে যেতে আটঘাট বেঁধে কাজ করছেন তাঁরা। এই তিন জনের মধ্যেও এ ব্যাপারে মারাত্মক ব্যস্ততা কখনওই দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকদের দাবি, শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের বারবার হুমকি দেওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মাধ্যমে শেয়ার বাজারের উপর বেআইনি প্রভাব খাটাতে চাইছেন তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুল্ক বা বাণিজ্যচুক্তি সংক্রান্ত ঘোষণা শুক্রবার বা রবিবার রাতে করতে দেখা যায় তাঁকে। যার প্রভাবে সপ্তাহভর চাঙ্গা থাকা স্টকের সূচক। উল্লেখ্য এর আগেও বেআইনিভাবে শেয়ার কেনাবেচার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার তিন মাসের মাথায় চলতি বছরের ২ এপ্রিল থেকে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করেন ট্রাম্প। অর্থাৎ, কোনও দেশ মার্কিন পণ্যের উপরে ঠিক যতটা শুল্ক নেয়, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটির পণ্যের উপর ঠিক ততটাই শুল্ক আমেরিকা নেবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। তাঁর ওই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা সমস্ত দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ওয়াশিংটনের শেয়ার বাজারের সূচকও রাতারাতি নিম্নমুখী হতে শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে ৯০ দিনের জন্য ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতিকে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। বলেন, এই সময়সীমার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ইচ্ছুক দেশগুলিকে সেরে ফেলতে হবে চুক্তি। তাঁর ওই হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা সেরে ফেলেছে বলে জানা গিয়েছে। কিছু কিছু রাষ্ট্র আবার সবুজ সঙ্কেত না দেওয়ায় সেখানে একচুলও এগোতে পারেনি ওয়াশিংটন।
এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে চাপ বাড়াতে ৭ জুলাই থেকে বিভিন্ন দেশকে চিঠি পাঠানো শুরু করেছেন ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি তার আগে লেখেন, ‘‘আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, সোমবার দুপুর ১২টা (আমেরিকার ইস্টার্ন টাইম জ়োন অনুযায়ী) থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে শুল্ক সংক্রান্ত চুক্তির চিঠি পাঠানো শুরু করবে যুক্তরাষ্ট্র।’’ তাঁর এই ঘোষণার ঠিক আগে হোয়াইট হাউসের আধিকারিক সব কিছু ফাঁস করায় বিষয়টিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কতটা গুরুত্ব দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আগামী ৯ জুলাই শেষ হচ্ছে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতির ৯০ দিন স্থগিতাদেশের সময়সীমা। এই অবস্থায় ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র চিঠি পাঠাবে কি না, পাঠালে নয়াদিল্লিকে তারা কোন তালিকায় রাখতে চলেছে, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তির ব্যাপারে কথাবার্তা বেশ কিছু দূর এগিয়েছে। যদিও তা চূড়ান্ত রূপ পায়নি।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যম সিএনএনের কাছে মুখ খুলেছেন মার্কিন রাজস্ব সচিব স্কট বেসান্ত। তিনি জানিয়েছেন, সময়সীয়া শেষ হওয়ার আগে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যচুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলার মুখে পৌঁছে গিয়েছে আমেরিকা। শুধু তা-ই নয়, চিন, ব্রিটেন এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে ইতিমধ্যে বাণিজ্যচুক্তি সেরেও ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন রাজস্ব সচিব বেসান্ত জানিয়েছেন, শুল্ক কমানোর কথা বলে ১০০টি দেশকে চিঠি পাঠাবেন ট্রাম্প। সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ওই দেশগুলি মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক না কমালে আগামী ১ অগস্ট থেকে ওই দেশগুলির উপর চড়া হারের শুল্ক (২ এপ্রিলের ঘোষণা অনুসারে) কার্যকর হবে।
ট্রাম্পের ঘোষণা করা ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতির নিয়মমাফিক ভারতীয় পণ্যে কর ধার্য হয়েছে ২৬ শতাংশ। সেটা এড়াতেই বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে চাইছে নয়াদিল্লি। কিন্তু সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও কিছু বিষয়ে একমত হতে পারছে না দুই দেশ। ফলে ওই চুক্তি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনি এখনও।
গত ৪ জুলাই অবশ্য ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। সেখানে তিনি বলেন, কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে আমেরিকার সঙ্গে নতুন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি সই করবে না নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, আর্থিক দিক থেকে লাভ-লোকসানের হিসাব কষেই যে কেন্দ্র কাগজে কলমের আঁচড় কাটতে চাইছে, তা স্পষ্ট।
গত ৬ জুলাই ব্রাজ়িলে ‘ব্রিক্স’ সম্মেলনে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরে ১০ দেশের ওই আন্তর্জাতিক জোট একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে সরাসরি আমেরিকার নাম উল্লেখ না করলেও শুল্ক ব্যবস্থার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ‘ব্রিক্স’।
ব্রাজ়িলে ‘ব্রিক্স’-এর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ, তা সে নির্বিচারে শুল্ক বৃদ্ধি করাই হোক বা অন্য কোনও ঘোষণা, আন্তর্জাতিক লেনদেনকে আরও পিছিয়ে দেয়। বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে।’’
শুল্ক নিয়ে ‘ব্রিক্স’-এর এই অবস্থান ট্রাম্পের যে পছন্দ হয়নি, তা নিজের সমাজমাধ্যম পোস্টে কোনও রাখঢাক না রেখেই বুঝিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ব্রিক্স-এর আমেরিকাবিরোধী নীতির সঙ্গে কোনও দেশ যুক্ত হলে তাদের উপর বাড়তি ১০ শতাংশ কর চাপানো হবে। এর কোনও ব্যতিক্রম হবে না।’’ এই কোপ ভারতের উপরে পড়বে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
ট্রাম্পের ওই হুমকির পরে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ‘ব্রিক্স’-এর অন্যতম সদস্যরাষ্ট্র চিন। তাঁর এই ধরনের হুঁশিয়ারিতে যথেষ্টই বিরক্ত বেজিং। ড্রাগনভূমির বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং জানিয়েছেন, অন্যের উপর চাপ তৈরির জন্য শুল্ককে ব্যবহার করা মেনে নেওয়া যায় না। এতে কারও কোনও লাভ হবে না।
‘ব্রিক্স’ভুক্ত দেশগুলির নিজস্ব মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দিয়েছেন সংগঠনটির অন্যতম সদস্যদেশ রাশিয়া। ব্রাজ়িলের সম্মেলনে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এতে বাকি রাষ্ট্রগুলি রাজি হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব কমবে মার্কিন ডলারের। এতে ট্রাম্পের যে রক্তচাপ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।