বিশ্ব অর্থনীতি ফের তলিয়ে যেতে পারে মন্দায়। আর, তা গত শতকের ৩০-এর দশকের মতোই সারা দুনিয়াকে অতল গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন এই হুঁশিয়ারিই দিয়ে এখন থেকে সতর্ক হতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এই মন্দা শুধু শিল্পোন্নত দুনিয়া বা সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রগুলিকে প্রভাবিত করবে, এমন নয়। সার্বিক ভাবে মন্দার কোপে পড়তে পারে সারা বিশ্ব। তাই আগেভাগেই তার সমাধানসূত্রও বার করে রাখতে হবে। ‘খেলার নতুন নিয়ম’ ঠিক করে নিয়ে এগোতে হবে। এবং তা করতে হবে একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে।’’
লন্ডন বিজনেস স্কুল আয়োজিত এক সভায় এই ইঙ্গিত দেন আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বা আইএমএফের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার পূর্বাভাস যে গুটিকয়েক অর্থনীতিবিদ দিয়েছিলেন, রাজন তাঁদের অন্যতম। ২০০৫ সালে অাইএমএফে থাকার সময়ে লেখা একটি গবেষণাপত্রে তিনি ওই মন্দার আভাস দেন।
রাজনের মতে, দুনিয়া জুড়ে সব শীর্ষ ব্যাঙ্ককে সম্ভাব্য সঙ্কট এড়াতে একসঙ্গে আলোচনা করে একমত হয়ে পথ বার করতে হবে। তার ভিত্তিতেই স্থির করতে হবে নতুন নীতি। বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক নিজেদের বাঁচাতে আর্থিক ত্রাণ প্রকল্প নিয়ে একে অপরের সঙ্গে যে-লড়াইয়ে নেমেছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সাবধান করেছেন রাজন।
তবে তিনি বলেছেন, ভারতের নীতি এ ক্ষেত্রে আলাদা। এখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মূলত ঋণে সুদ কমানোর উপরই জোর দেয়, যাতে শিল্পের হাতে বাড়তি নগদের জোগান দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো যায়। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ ভাবে ত্রাণ প্রকল্প চালু করে অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে চাই না। তাই সেই দরজা বন্ধ রেখে শুধু ঋণে সুদ কমিয়ে লগ্নি বাড়ানোর দিকেই নজর দিই।’’ এখানে আর্থিক বৃদ্ধিকে টেনে তুলতে দুনিয়া জুড়ে নির্বিচারে নোট ছাপানোর যে-নীতি নেওয়া হয়েছে, তার বিরূপ প্রভাবের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন রাজন। এর প্রভাব শুধু ঋণে সুদ কমানোয় সীমিত থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে সব ক্ষেত্রে। এর পরিণামে উৎপাদন বাড়লেও আসলে তার পিছনে কোনও শক্ত ভিত থাকে না। তিনি বলেন, ‘‘এমন এক আর্থিক বৃদ্ধির পথে হাঁটতে চাইছে দুনিয়া, যার পিছনে কোনও ভিত নেই। ফলে সম্পদ সৃষ্টির বদলে একটি দেশের উন্নতির বিনিময়ে এগোতে চাইছে আর একটি রাষ্ট্র।’’
বস্তুত, ২০০৮-এর মন্দার পর থেকেই অর্থনীতির হাল ফেরাতে বাড়তি নোট ছাপিয়ে মুদ্রার দাম কমানোর খেলায় মেতেছে উন্নত দুনিয়ার একের পর এক রাষ্ট্র। তাদের যুক্তি হল:
• অর্থনীতিতে নগদের জোগান বাড়লে পণ্যমূল্যও বাড়বে। আরও দাম বাড়ার আশঙ্কায় বাড়বে কেনাকাটাও। যা উৎসাহ দেবে শিল্পোৎপাদনে।
• কমবে ঋণে সুদ।
• সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রার দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কমবে, যা তার রফতানি বাড়াতে সাহায্য করবে।
• ওই দেশের আমদানিও কমবে।
আর্থিক ত্রাণ প্রকল্পের হাত ধরে নোট ছাপিয়েই নগদের জোগান বাড়িয়েছে মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রবণতা সংক্রামক, তাই সহজেই তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য দেশে। ফলে ২০১৩ থেকে একই রাস্তা নেয় জাপানের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। জাপানের এই পদক্ষেপে কমতে থাকা পণ্যমূল্য বাড়ে। নেমে আসে ডলারে ইয়েনের দাম। ২০১২-র গোড়ায় প্রতি ডলারের দাম ছিল ৭৬ ইয়েন, এখন তা ১২৩ ইয়েন, যা গত ৩০ বছরে সবচেয়ে কম। ইয়েনের এই নাটকীয় পতনে স্বাভাবিক ভাবেই মার খায় চিন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের রফতানি। ফলে মুদ্রার দাম কমায় তারাও। চিনা পণ্য রফতানি বাজারে এগিয়ে যেতে শুরু করে। উন্নত দুনিয়ার রফতানির উপর নতুন করে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। ফলে সক্রিয় হয় একই দুষ্টচক্র।
মুদ্রার দাম কমানোর এই প্রতিযোগিতা নিয়েই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজন, যাতে শেষ পর্যন্ত সব দেশের বৃদ্ধিই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। ১৯৩০-এর মন্দার সময়েও বিশ্ব জুড়ে এই ছবিই ফুটে উঠেছিল বলে সতর্ক করেছেন তিনি। সে সময়ে অর্ধেক হয় বিশ্ব বাণিজ্য, কর রাজস্ব, শিল্পের মুনাফা নেমে আসে তলানিতে। সাধারণ মানুষের আয়, কৃষি উৎপাদন, শেয়ার বাজার— সব কিছুকেই গ্রাস করে ভয়াবহ মন্দা।
ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি সম্পর্কেই দুনিয়াকে সাবধান করে দিয়েছেন রঘুরাম রাজন।